ফ্রান্স থেকে বহিষ্কৃত তরুণের জঙ্গিবাদ সম্পৃক্ততা খতিয়ে দেখছে পুলিশ
2021.02.12
ঢাকা

জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়া, সিরিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়া এবং ফ্রান্সে হামলার পরিকল্পনাসহ বিদেশে নানা অপরাধে অভিযুক্ত বাংলাদেশি যুবক সাইফ রহমান ওরফে তোতনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য শুক্রবার রিমান্ডে নিয়েছে ঢাকার পুলিশ।
জিজ্ঞাসাবাদের সময় ইসলামিক স্টেটসহ (আইএস) আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে সাইফের সম্পৃক্ততার যে তথ্যপ্রমাণ ফরাসি পুলিশ দিয়েছে, সেগুলো ছাড়াও বাংলাদেশের জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা আছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ততার অভিযোগে ফ্রান্স থেকে বহিষ্কৃত ২৪ বছর বয়সী সাইফ গত ১৪ জানুয়ারি ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছার পরই তাঁকে আটক করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট।
ফরাসি নথির বরাত দিয়ে সিটিটিসি’র উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি, তদন্ত) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বেনারকে জানান, সেখানকার আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তাঁর ‘ডিজিটাল ডিভাইস’ বিশ্লেষণ করে জঙ্গি তৎপরতা এবং আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে।
“সিটিটিসির হাতে আসা ফরাসি নথি অনুযায়ী, ২০১৯ সাল থেকে জিহাদি প্রচারণায় জড়িত ছিল সাইফ। ২০২০ সালে সে ইরাক ও সিরিয়ার আইএস নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। সেখানে যাওয়ার আগেই তাকে আটক করে ফরাসি পুলিশ,” জানান সাইফুল ইসলাম।
বাংলাদেশে পাঠানোর আগে সাইফকে ফ্রান্সের একটি বন্দিশালায় রাখার তথ্য জানিয়ে সাইফুল ইসলাম আরও জানান, আইএস-অধ্যুষিত অঞ্চলে যেতে ব্যর্থ হওয়া যুবকেরা প্রায়ই তাদের চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে সন্ত্রাসী হামলা চালায়—এমন ভাবনা থেকেই ফ্রান্সের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেখানে সাইফের উপস্থিতিকে নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করে তাঁকে বহিষ্কার করার সুপারিশ করেছিল।
“সাইফকে দেশটির আদালতের মাধ্যমেই বহিষ্কার করা হয়েছে,” বলেন ডিসি সাইফুল।
সাইফের বিষয়ে ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দপ্তর এবং ঢাকায় ফরাসি দূতাবাসের কাছে তথ্য জানতে চেয়ে ই–মেইল করা হলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
সিটিটিসি কর্মকর্তারা জানান, গত ১৪ জানুয়ারি সাইফকে সন্দেহজনক ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করে আদালতে উপস্থিত করলে বিচারক তাঁকে কারাগারে পাঠান।
পরবর্তীতে জেলগেটে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সাইফের কাছ থেকে উদ্ধার করা ফরাসি ভাষায় লেখা দুই পৃষ্ঠার একটি নথি অনুবাদ করে তাঁর জঙ্গি তৎপরতার বিবরণ জানতে পারেন সিটিটিসির কর্মকর্তারা।
এর প্রেক্ষিতে তাঁর বিরুদ্ধে ২৯ জানুয়ারি বিমানবন্দর থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করা হয়। ৩ ফেব্রুয়ারি তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আবেদন জানায় পুলিশ। ৮ ফেব্রুয়ারি দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত। শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া তাঁর রিমান্ডের মেয়াদ শেষ হবে শনিবার।
তাঁর ল্যাপটপ ও সেলফোন জব্দ করে ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে বলেও জানান কর্মকর্তারা।
কে এই সাইফ?
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, ১৯৯৭ সালে জন্ম নেওয়া সাইফ ঢাকায় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ‘এ লেভেল’ এবং ‘ও লেভেল’ শেষ করে ২০১৫ সালে ফ্রান্সে পাড়ি জমান।
ফ্রান্সের সের্গি-পন্টাইস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৬ সালে স্নাতক শেষ করে সেখানকার পান্থন-আসাস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন শাখায় খণ্ডকালীন চাকরি করতেন।
সাইফের আদি বাড়ি ঢাকার দোহার-নবাবগঞ্জ এলাকায়। তাঁর বাবা লুৎফর রহমান এবং মা জেরিন রহমানও ফ্রান্সে থাকতেন। সাইফ তাঁদের একমাত্র সন্তান।
“সাইফকে ফ্রান্স পুলিশ আটক করার পরপরই তার মা জেরিন রহমান দেশে চলে আসেন। তবে তার বাবা এখনো ফ্রান্সেই আছেন,” বলেন সিটিটিসির কর্মকর্তা সাইফুল।
সাইফ সম্পর্কে তথ্য পেতে তার মাকে খোঁজা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তদন্তকারীরা।
তবে দোহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তফা কামাল শুক্রবার বেনারকে বলেন, “সাইফ বা তাঁর পরিবার সম্পর্কে আমরা এখন পর্যন্ত কিছু জানি না।” একই কথা জানিয়েছেন নবাবগঞ্জ থানার ওসি মো. সিরাজুল ইসলাম শেখ।
পুলিশ কর্মকর্তাদের ধারণা, ফ্রান্সে গিয়েই অনলাইন প্রচারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন সাইফ।
“ফ্রান্সে বসে যদি সে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়” সেক্ষেত্রে “বাংলাদেশের কোনো দায় নেই” বলে মন্তব্য করেন সামরিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন।
তবে তাঁর মতে, “বিষয়টিকে হাল্কাভাবে নেওয়ারও সুযোগ নেই।” সাইফের গতিবিধি ও কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করে “বাংলাদেশ থেকে কেউ আইএসের সাথে জড়াচ্ছে কিনা, সেদিকে নজর দিতে হবে।”
প্রসঙ্গত, ফ্রান্সে ইসলামের মহানবীর কার্টুন নিয়ে দেশটির প্রেসিডেন্টের মন্তব্যের প্রতিবাদে গত অক্টোবর-নভেম্বর মাসে বাংলাদেশে ইসলামপন্থী দলগুলো ধারাবাহিক বিক্ষোভ করে। এসব দল ফ্রান্সের সঙ্গে বাংলাদেশের সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবিও তুলেছিল।