বাংলাদেশি জঙ্গি তানভীর আফগানিস্তানে গ্রেপ্তার

কামরান রেজা চৌধুরী
2020.04.15
ঢাকা
200415_Militant_Arrested_Afghanistan-Bangla_1000.JPG জঙ্গিবিরোধী অভিযানের সময় ঢাকার পশ্চিম নাখালপাড়ায় এক সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানা ঘিরে র‍্যাবের পাহারা। ১২ জানুয়ারি ২০১৮।
[বেনারনিউজ]

তিন বছর আগে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে ব্যর্থ জঙ্গি হামলার সাথে সম্পৃক্ত নব্য জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) নেতা মোহাম্মদ তানভীরকে আফগানিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আটক করেছে। আফগান সরকার জানিয়েছে, দেশটির খোরাসান প্রদেশে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তানভীর।

বাংলাদেশের পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা তানভীর ২০১৬ সালে ‘হিযরত করতে’ আফগানিস্তান চলে যান। ইসলামিক স্টেটের ব্যানারে বাংলাদেশে যারা জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনা করে তানভীরের সাথে তাদের যোগাযোগ ছিল বলেও জানান কর্মকর্তারা।

আফগানিস্তানের সংবাদ মাধ্যম খামা দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে জানায়, খোরাসান প্রদেশে ইসলামিক স্টেটের দুজন সিনিয়র নেতাকে আটক করেছে আফগান গোয়েন্দা সংস্থা। তাঁদের একজন বাংলাদেশি এবং আরেকজন পাকিস্তানি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, আটক বাংলাদেশির নাম মোহাম্মদ তানভীর, যিনি ওমরান, আহমাদ ও নাসির ছদ্মনামও ব্যবহার করে থাকেন।

খোরাসান প্রদেশের ইসলামিক স্টেটের নেতাদের মধ্যে গোপন যোগাযোগ রক্ষা করতে তানভীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিলেন বলেও জানায় ওই সংবাদ সংস্থা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আফগানিস্তানে তানভীরের ধরা পড়ার খবর গণমাধ্যমে জেনেছেন জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বুধবার বেনারকে বলেন, “আফগান সরকার তার ব্যাপারে আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি। সাধারণত তারা আমাদের এসব ব্যাপারে কিছু জানায় না।”

তবে তানভীরের পরিচয় নিশ্চিত করে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তানভীর একজন বড়ো মাপের জঙ্গি।

কার্যালয় বন্ধ থাকায় তানভীরের ব্যাপারে ঢাকাস্থ আফগান দূতাবাস থেকে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি। বেনারের পক্ষ থেকে বুধবার আফগানিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মূখপাত্র গ্র্যান হেওয়াদের কাছে ই-মেইল পাঠানো হলেও তিনি কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি।

‘বড়ো মাপের’ জঙ্গি

আফগানিস্তানে তানভীরের ধরা পড়ার সংবাদ অবগত আছেন জানিয়ে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমস ইউনিটের ডেপুটি কমিশনার সাইফুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “সে একটি বড় ক্যাচ (বড়ো মাপের জঙ্গি)। তার ব্যাপারে আমাদের এলার্ট ছিল।”

“আফগানিস্তানের সাথে আমাদের কোনো কাউন্টার টেররিজম সংক্রান্ত সহযোগিতা নেই,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সাতদিন আগে একটি বিদেশি সংস্থা থেকে তানভীর সম্পর্কে আমাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়। আমরা তার সম্পর্কে তথ্য প্রদান করি। পরে তারা আমাদেরকে নিশ্চিত করে যে, তানভীরই আফগানিস্তানে আটক হয়েছে।”

সাইফুল জানান, তানভীর মূলত একজন ইঞ্জিনিয়ার, বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন ইন্সটিটিউটে (আইবিএ) এমবিএ পড়েছেন। সেখানে লেখাপড়া করা অবস্থায় তিনি ২০১৬ সালে ‘হিযরত করতে’ আফগানিস্তান চলে যান।

বাংলাদেশে যারা আইএসের নামে বিভিন্ন জঙ্গি কার্যক্রম চালাত তাদের সাথে তানভীরের যোগাযোগ ছিল জানিয়ে উদাহরণ হিসেবে সাইফুল বলেন, “২০১৭ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে আক্রমণের জন্য পান্থপথের হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে যে জঙ্গি সাইফুল আশ্রয় নিয়েছিল, তাঁদের সাথেও তানভীরের যোগাযোগ ছিল।”

সাইফুল জানান, তানভীরের বাসা ঢাকার মাটিকাটা অঞ্চলে। তাঁর বোনও জঙ্গি কার্যক্রমের সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনিও তানভীরের মতো হিযরত করতে চেয়েছিলেন, তবে বিয়ে হয়ে যাওয়ার কারণে তিনি সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন।

তানভীরের ওই বোন হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনাল আত্মঘাতী হামলার একজন সাক্ষী বলেও জানান সাইফুল।

২০১৭ সালের ১৪ আগস্ট রাতে জঙ্গি সাইফুলকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের কাছে হোটেল ওলিওতে শনাক্ত করে পুলিশ। পুলিশ তাঁকে সারারাত ঘিরে রাখে। পরে পালাতে না পেরে বোমা ফাটিয়ে আত্মহত্যা করেন জঙ্গি সাইফুল।

পুলিশের ভাষ্য, ১৫ আগস্ট সকালে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের সময় সেখানে বোমা হামলার পরিকল্পনা ছিল জঙ্গি সাইফুলের।

গত বছর ৯ ডিসেম্বর ঢাকার সন্ত্রাস বিরোধী আদালত হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে আত্মঘাতী হামলার অভিযোগ গঠন করে। এতে নিহত জঙ্গি সাইফুল এবং আফগানিস্তানে আটক তানভীরসহ মোট ১৪ সন্দেহভাজনকে অভিযুক্ত করা হয়।

বিচারের জন্য তানভীরকে আফগানিস্তান থেকে ফেরত আনা হবে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম বলেন, “আফগানিস্তানের সাথে আমাদের বন্দী বিনিময় চুক্তি নেই। সেকারণে আমরা তাঁকে ফেরত আনতে পারছি না।”

তানভীরের ব্যাপারে আফগানিস্তানের সাথে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক কোনো যোগাযোগ হয়নি জানিয়ে সাইফুল বলেন, “তবে আমরা তানভীরের ব্যাপারে ইন্টারপোলের মাধ্যমে আফগানিস্তান সরকারের সাথে যোগাযোগ করব।”

বাংলাদেশ থেকে কমপক্ষে ৫০ জন সন্দেহভাজন জঙ্গি বিভিন্ন দেশে ইসলামিক স্টেটের পক্ষে যুদ্ধ করতে গেছেন বলেও জানান সাইফুল।

“এই সকল জঙ্গিদের ব্যাপারে দেশের সকল বিমানবন্দর, স্থলবন্দর, সমুদ্রবন্দরে তথ্য রাখা আছে। তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে চেষ্টা করলেই গ্রেপ্তার করা হবে,” বলেন তিনি।

এদিকে ইরানের সীমান্তবর্তী আফগানিস্তানের শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ খোরাসান প্রদেশে তালেবানদের পাশাপাশি আইএস বেশ সক্রিয় ও শক্তিশালী বলে বেনারকে জানান নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন।

খোরাসানে আইএস ২০১৫ সালের পর থেকে কার্যক্রম শুরু করে জানিয়ে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ থেকে যারা ইরাক-সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের পক্ষে যুদ্ধ করতে গেছে, তারাই মূলত আফগানিস্তানে ইসলামিক স্টেটে যোগ দিয়েছে। ইরাকে ইসলামিক স্টেটের পতনের পর তারা আফগানিস্তান চলে যায়।”

“আফগানিস্তানে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া কতজন জঙ্গি আছে তা বলা মুশকিল। তবে আছে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়। এর আগেও বাংলাদেশি জঙ্গি আফগানিস্তানে ধরা পড়েছে,” বলেন ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।