হলি আর্টিজান হামলার পাঁচ বছর: করোনার কারণে বড়ো আয়োজন নেই, তবু ঘটনাটিকে ‘আমরা ভুলে যেতে পারি না’

কামরান রেজা চৌধুরী ও আহম্মদ ফয়েজ
2021.06.28
ঢাকা
হলি আর্টিজান হামলার পাঁচ বছর: করোনার কারণে বড়ো আয়োজন নেই, তবু ঘটনাটিকে ‘আমরা ভুলে যেতে পারি না’ ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর সেখানে পুলিশের পাহারা। ৩ জুলাই ২০১৬।
[রয়টার্স]

দেশের সবচে ভয়াবহ জঙ্গি আক্রমণের ঘটনা, ঢাকার হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পাঁচ বছর পূর্তি হতে যাচ্ছে করোনাভাইরাসের কঠোর লকডাউনের ভেতর। ফলে দিবসটিকে ঘিরে বড়ো কোনো আয়োজন না হলেও ওই হামলাকে “আমরা ভুলে যেতে পারি না” বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।

মহামারির সংক্রমণ ঠেকাতে, হামলার বার্ষিকী, পহেলা জুলাই থেকে শুরু হওয়া কঠোর লকডাউনের কারণে বড়ো পরিসরে হামলার বার্ষিকী পালন করা সম্ভব হচ্ছে না জানিয়ে সোমবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বেনারকে বলেন, “হলি আর্টিজান হামলাকে আমরা ভুলে যেতে পারি না।” 

এদিকে হলি আর্টিজান বেকারিতে মর্মান্তিক হামলার পর থেকে গত পাঁচ বছর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর দক্ষ তৎপরতায় বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনগুলো বড়ো কোনো সন্ত্রাসী আক্রমণ চালাতে পারেনি বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

যদিও বিশ্লেষকদের মতে, অনলাইনে জঙ্গিদের ব্যাপক উপস্থিতি নতুন শঙ্কার জন্ম দিয়েছে, যা এখনও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। 

২০১৬ সালের পহেলা জুলাই রাতে ঢাকার কূটনৈতিক পাড়া গুলশানের ৭৯ নম্বর রোডের পাঁচ নম্বর প্লটে অবস্থিত হলি আর্টিজান বেকারি ও ক্যাফেতে অতর্কিত হামলা চালায় নব্য জামায়াতুল মুজাহিদিনের (জেএমবি) পাঁচ জঙ্গি। তারা সেখানকার অতিথিদের জিম্মি করে বিদেশিদের আলাদা করে প্রথমে চাপাতি দিয়ে ও পরে গুলি করে ২০ জনকে হত্যা করে।

ঘটনার পর সিরিয়াভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট এই ঘটনার দায় স্বীকার করেছিল।

তবে ওই জঙ্গিরা ‘হোম গ্রোন’ সংগঠন নব্য জেএমবির সদস্য বলে বেনারকে জানিয়েছেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান এম আসাদুজ্জামান।

ঘটনার পরদিন সেনাবাহিনীর কমান্ডো অপারেশনের মাধ্যমে এই ঘটনার পরিসমাপ্তি হয়। জঙ্গি হামলার সময় ও পরবর্তীতে পাঁচ জঙ্গি ও দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ মোট ২৯ জন দেশি–বিদেশি নাগরিক প্রাণ হারান। 

নিহতদের মধ্যে নয়জন ইতালি, সাতজন জাপানি, একজন ভারতীয় এবং একজন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক রয়েছেন। 

দীর্ঘ তদন্তের পর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট ওই ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেয়। তদন্তে বেরিয়ে আসে ঘটনার সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে ২১ জন যুক্ত ছিলেন। এদের মধ্যে ঘটনাস্থলে পাঁচজন এবং ঘটনার পর বিভিন্ন সময়ে আরও আটজন মারা যান।

তিন বছরের বেশি সময় পর ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে ঢাকার সন্ত্রাস বিরোধী ট্রাইবুনাল সাত জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। 

2.JPG
ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় নিহতদের মরদেহ নিয়ে যাচ্ছেন শোকার্ত স্বজনরা। ৪ জুলাই ২০১৬। [রয়টার্স]

উগ্রবাদ নিয়ন্ত্রণ হলেও নির্মূল হয়নি

বাংলাদেশ পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের প্রধান মো. কামরুল আহসান বেনারকে বলেন, হোলি আর্টিজান হামলা থেকে শিক্ষা নিয়ে পুলিশ প্রশিক্ষণ বৃদ্ধি করেছে, উন্নতমানের সরঞ্জামাদি ও যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করেছে এবং জনবল বৃদ্ধি করেছে।

তিনি বলেন, “আমরা সফলভাবে কয়েক দফা জঙ্গি হামলা ব্যর্থ করে দিয়েছি। বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা প্রায়ই ধরা পড়ছে এবং সাইবার জগতে তাদের আদর্শ প্রচারে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি উদ্ধার করা হচ্ছে।”

এদিকে অনলাইনে সন্ত্রাস প্রতিরোধের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি ফেসবুকও কাজ করছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন ফেসবুকের এক মুখপাত্র। 

এক ইমেইল বার্তার উত্তরে তিনি বেনারকে জানান, “ফেসবুকে সন্ত্রাসের কোনো স্থান নেই। আমাদের দৃষ্টিগোচর হলেই আমরা সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসীদের সমর্থনে দেয়া পোস্ট সরিয়ে ফেলি। কেউ আমাদের নজরে আনার আগেই এই বছরের প্রথম তিন মাসে সন্ত্রাস সম্পর্কিত ৯০ লাখ পোস্ট সরিয়েছি।”

তবে বাংলাদেশ থেকে সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসীদের সমর্থনে কত সংখ্যক পোস্ট করা হয়েছে সে ব্যাপারে তিনি কিছু জানাননি। 

এদিকে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এ এন এম মুনিরুজ্জামানের মতে “অনলাইনে উগ্রবাদ প্রচার পুরো মাত্রায় চলছে।”

তিনি বলেন, করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে মানুষ এখন অনলাইনে বেশি সময় ব্যয় করছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তারা উগ্রবাদী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।

মুনিরুজ্জামান বলেন, এই অবস্থা আশঙ্কার। কারণ তারা এই অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে নতুন সদস্য সংগ্রহ করে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, উগ্রবাদ যে নির্মূল হয়েছে সে কথা কোনভাবেই বলা যাবে না। মাঝে মধ্যেই পুলিশ জঙ্গিদের আস্তানা থেকে অস্ত্র ও বারুদ উদ্ধার করছে। কাজেই এটি পরিষ্কারভাবে বলা যায়, জঙ্গি গ্রুপগুলো সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। 

হাসনাত করিম: দুই বছর জেল খেটে অভিযোগ মুক্ত

হলি আর্টিজান হামলার দিন এক মেয়ের জন্মদিন পালন করতে সপরিবারে সেখানে গিয়েছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক হাসনাত করিম। সন্ত্রাসীরা হামলার আগে তাঁদের ছেড়ে দেয়।

এই কারণে তিনি পুলিশের সন্দেহের তালিকায় ছিলেন। পুলিশ জানায়, হাসনাত করিমের ফোন থেকে আক্রমণকারীরা ইসলামিক স্টেটকে হত্যাকাণ্ডের ছবি পাঠায়। ঘটনার একমাস পর পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। প্রায় দুই বছর তিনি কারাগারে ছিলেন।

তবে তদন্তে এই আক্রমণের সাথে হাসনাত করিমের কোনো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি, ফলে তাঁকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।

“উনার কোনো সংশ্লিষ্টতা আমি পাইনি। যদি উনি এই আক্রমণের সাথে কোনোভাবে জড়িত থাকতেন তাহলে তিনি তো আর স্ত্রী, দুই মেয়ে নিয়ে সেখানে যেতেন না। একা যেতেন। তাই তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়নি,” বেনারকে বলেন তদন্ত কর্মকর্তা হুমায়ূন কবির। 

হলি আর্টিজান হামলার ব্যাপারে তাঁর স্ত্রী শারমিনা পারভীন এর আগে বেনারকে জানান, হোলি আর্টিজান হামলা যে কীভাবে আমাদের জীবন পরিবর্তন করে দিয়েছে তা কেউ বুঝতে পারবে না।

তিনি বলেন, তাদের দুই সন্তান নিয়ে সেই রাতে এক মেয়ের জন্মদিন পালনের জন্য হোলি আর্টিজান রেস্তোরায় গিয়েছিলেন। এখন তাদের দুই মেয়ে আর বাইরে, এমনকি কোনো শপিংয়ে যেতে চায় না। তাদের ট্রমা এখনও কাটেনি। 

3.JPG

স্মৃতি এখনো তাড়িয়ে বেড়ায়

বেনারের পক্ষ থেকে চেষ্টা করেও হলি আর্টিজান বেকারির মালিক বা হামলায় নিহতদের পরিবারের কারো কোনো মন্তব্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।

তবে হামলার দিন ভেতরে থাকা হলি আর্টিজান বেকারির এক কর্মী শাহরিয়ার বেনারকে জানান, হামলার বার্ষিকীতে তিনি ওই স্থানে যেতে চান না।

ওই দিনের ঘটনা স্মরণ করে তিনি বলেন, “তারা আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে আমাদের জিম্মি করে ফেলে। অন্য কর্মীদের সাথে আমাকেও আলাদা জায়গায় আটকে রেখে তাণ্ডব চালাতে থাকে।”

“ওই দিন (বার্ষিকীর দিন) আমি সেখানে যেতে চাই না। ওই ঘটনা মনে করলে আমার এখনো আতঙ্ক হয়। আমি ওই ঘটনাটা ভুলে যেতে চাই। ঘটনাটা একবার মনে করলেই সেটা আমাকে বহুদিন তাড়িয়ে বেড়ায়।” 

এদিকে ঢাকাস্থ জাপানী দূতাবাস হলি আর্টিজান হামলার স্থানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের পরিকল্পনা করছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।

তিনি বলেন, “তাঁদের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবনা পেলে আমরা এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সহায়তা করার কথা বিবেচনা করব।”

স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের বিষয়ে জাপান দূতাবাসের বক্তব্য চাওয়া হলেও তা পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া হলি আর্টিজানে হামলায় নিহত সব দেশি–বিদেশি নাগরিকের ছবি পাওয়া গেলেও জাপান দূতাবাস এখন পর্যন্ত দেশটির নিহত সাত নাগরিকের ছবি প্রকাশ করেনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।