জঙ্গি অপবাদ থেকে মুক্ত হলেও ক্ষতিপূরণ পাননি হলি আর্টিজানের নিহত কর্মী সাইফুল ও শাওনের পরিবার

আহম্মদ ফয়েজ
2021.06.29
ঢাকা
জঙ্গি অপবাদ থেকে মুক্ত হলেও ক্ষতিপূরণ পাননি হলি আর্টিজানের নিহত কর্মী সাইফুল ও শাওনের পরিবার নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের ভাণ্ডারী পুল এলাকার একটি ভবনের ছাদে নিজের ছেলের ছবি হাতে হলি আর্টিজান হামলার ঘটনার জেরে নিহত নিরপরাধ জাকির হোসেন শাওনের মা মাকসুদা বেগম। ২৯ জুন ২০২১।
[আহম্মদ ফয়েজ/বেনারনিউজ]

গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার ঘটনার জেরে প্রাণ হারানো বাবুর্চি সাইফুল ইসলাম চৌকিদার ও তাঁর সহকারী জাকির হোসেন শাওনের পরিবারের কান্না এখনো থামেনি। ঘটনার পাঁচ বছর হতে চললেও বিচার বা ক্ষতিপূরণ দূরের কথা পরিবারগুলো পায়নি ন্যূনতম সান্ত্বনাটুকু। 

২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পরদিন আইনশৃঙ্খলা-বাহিনী ও নিরাপত্তা-বাহিনীর সম্মিলিত অভিযানে পাঁচ জঙ্গির সঙ্গে নিহত হন বাবুর্চি সাইফুল। গুরুতর আহত অবস্থায় আটক সাইফুলের সহকারী শাওন এক সপ্তাহ পর পুলিশ হেফাজতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। 

প্রাথমিকভাবে সাইফুল ও শাওনকে জঙ্গিদের সহযোগী হিসেবে সন্দেহ করা হয়েছিল। গ্রেপ্তারও দেখানো হয়েছিল রক্তাক্ত শাওনকে। তবে ঘটনার দুই বছর পর ২০১৮ সালে ২৩ জুলাই আদালতে জমা দেয়া অভিযোগপত্রে নাম আসেনি সাইফুল ও শাওনের। 

পুলিশ কোনো জঙ্গি সম্পৃক্ততা খুঁজে পায়নি এই দুই রেস্টুরেন্ট কর্মীর। এর প্রেক্ষাপটে পরিবার দুটি জঙ্গি অপবাদ থেকে মুক্ত হলেও ক্ষত কাটেনি স্বজন হারানোর। 

এই দুই পরিবারের অভিযোগ, শুধুমাত্র সন্দেহের কারণে সাইফুল ও শাওন নিহত হলেও কোনো কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত ওই পরিবারগুলোকে কোনো রকম সান্ত্বনা দেয়নি। মেলেনি ন্যূনতম ক্ষতিপূরণ বা বিচারের আশ্বাস। এখনো স্বজন হারানেরা বেদনায় কেঁদে চোখ ভাসান সাইফুলের স্ত্রী সোনিয়া বেগম ও শাওনের মা পিঠা বিক্রেতা মাকসুদা বেগম। 

‘আমরা কি বিচার পাওয়ার অধিকার রাখি না?’

নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জের ভাণ্ডারী পুল এলাকার একটি বস্তিতে থাকেন শাওনের বাবা আব্দুস সাত্তার, মা মাকসুদা, ছোট ভাই আরাফাত হোসেন এবং বোন সাদিয়া আক্তার। ভাণ্ডারী পুলের ওই বস্তিতে বেনারের সঙ্গে কথা হয় মাকসুদার। 

তিনি বলেন, দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে সন্তান হত্যার বিচার চেয়ে আসলেও এখনো কোনো সাড়া মেলেনি কারো পক্ষ থেকে। 

“শুধু সন্দেহের কারণেই আমি সন্তান হারা হলাম। এটা কি ঠিক? আমরা কি বিচার পাওয়ার অধিকার রাখি না? আমাদের জায়গায় যদি আজকে কোনো ধনি পরিবার হতো তাহলে তো ঠিকই সরকারের অনেক বড়ো বড়ো মন্ত্রীরা ছুটে যেত। আমরা গরিব বলে কি একটু সান্ত্বনা পাওয়ার অধিকারও নেই?” প্রশ্নগুলো শাওনের মা মাকসুদার। 

তিনি বলেন, শাওন ছিল তাঁর পরিবারের আয়ের অন্যতম উৎস। সন্তান হারিয়ে এখন অর্থ কষ্টে দিন কাটছে তাঁর। 

“হলি আর্টিজান কর্তৃপক্ষ এখনো আমাকে প্রতিমাসে কিছু টাকা দেয়। কিন্তু আমি অসুস্থ মানুষ, চোখে সমস্যা, ডায়াবেটিসের সমস্যা, অনেক ওষুধ কিনতে হয়। আমরা অনেক কষ্টে আছি… আমাদের কথাগুলো কেউ শোনে না,” বলেন মাকসুদা। 

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাঁর দাবি তাঁর সন্তান হত্যার যেন বিচার হয় এবং তাঁর পরিবার যেন ন্যায্য ক্ষতিপূরণ পায়।

“সরকার কি বুঝে না, এই গরিব পরিবারের ছেলে শাওনকে সন্দেহবশত মারা হয়েছে, সাইফুলকে মারা হয়েছে… এর ক্ষতিপূরণ কি আমরা পাব না?” বলেন মাকসুদা। 

“আমি এখন অসহায় নিঃস্ব। আমার আশা-ভরসা সব পুলিশ নষ্ট করে দিলো। কী একটা গণতুফান আসলো… কালো বাতাসের মতো আমার সন্তান আর সাইফুলকে নিয়ে গেলো,” কান্না করতে করতে বলেন মাকসুদা। 

সাইফুল চৌকিদারের স্ত্রী সোনিয়া বেগম শরিয়তপুর থেকে টেলিফোনে বেনারকে বলেন, “আমাদের সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রকার যোগাযোগ করা হয়নি। কেউ কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিষয়েও কথা বলেনি।" 

সোনিয়া বলেন, তাঁর পরিবারের আয়ের একমাত্র উৎসই ছিলেন তাঁর স্বামী। স্বামীকে হারিয়ে তিন সন্তানের পরিবার নিয়ে চলতে হিমশিম খান তিনি। 

“হলি আর্টিজান থেকে মাসে মাসে কিছু টাকা দেয় আমাদের। আমি সেলাই কাজ করে কিছু রোজগারের চেষ্টা করি, আর আত্মীয়-স্বজনের সাহায্য নিয়েই চলছে আমার পরিবার,” যোগ করেন সোনিয়া। 

দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে সোনিয়ার পরিবার। বড় মেয়ে অষ্টম আর ছোট মেয়ে পড়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে। সাড়ে চার বছর বয়সের একমাত্র পুত্রটিও এখন বুঝতে শিখে গেছে বাবা আর আসবে না। 

“উনি [সাইফুল] যখন মারা যান, তখন ছেলেটা আমার গর্ভে। জন্মের পর আস্তে আস্তে ছেলে যখন তার বাবাকে খুঁজতে শুরু করল তখন আমরা বলতাম তার বাবা বিদেশে। কিন্তু এখন নানা জনের মুখে শুনতে শুনতে ছেলে বুঝে গেছে তার বাবা আর আসবে না। বাবা মারা গেছে তার জন্মের আগেই,” বলেন সোনিয়া। 

তিনি বলেন, তদন্তে যে তাঁর স্বামী জঙ্গি নন বলে প্রমাণিত হয়েছেন, এতে তিনি খুশি। 

“কী আর বলব, এখন আর কারো কাছে কোনো দাবিও করতে চাই না। শুধু এতটুকু বলব আর কোন সন্তানকে যেন এভাবে বাবা-হারা হতে না হয়,” বলেন সোনিয়া। 

‘ক্ষতিপূরণ না পাওয়া খারাপ দৃষ্টান্ত’

হলি আর্টিজান বেকারির মালিক সাদাত মেহেদী বেনারকে বলেন, মানবিক দিক বিবেচনায় তাঁরা ওই ঘটনায় নিহত বাবুর্চি সাইফুল ইসলাম চৌকিদার ও তার সহযোগী জাকির হোসেন শাওনের পরিবারকে প্রতিমাসে কিছু আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছেন। 

“তারা সরকারের দিক থেকে কোনো প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা পায়নি। আমরা মানবিক দিক বিবেচনা করে এই দরিদ্র পরিবারগুলোকে সামান্য সহযোগিতা দিয়ে আসছি,” বলেন সাদাত। 

তিনি আরো বলেন, প্রতি বছর জুলাইয়ের ১ তারিখে ঘটনার দিন স্মরণ করে ক্যাফেটিতে কিছু আয়োজন করা হলেও এ বছর করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় তেমন কোনো পরিকল্পনা নেই। 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তাৎক্ষণিকভাবে মন্তব্য করতে রাজি হননি র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। 

“বিষয়টি ভালো করে খোঁজ-খবর করে তারপর এ বিষয়ে কথা বলতে হবে,” বলেন মামুন। 

মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, একটা ঘটনার পর ত্রুটি হতেই পারে। সন্দেহমূলক হতে পারে, কিন্তু যখন এটা স্পষ্ট হয়ে গেলো যে যারা মারা গেছেন, তারা জঙ্গি নন, তখন অবশ্যই দায়িত্বশীল হবার প্রয়োজন আছে। 

“দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে বাবুর্চি সাইফুলের লাশটাও তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। অনেক অনুনয়-বিনয় করেছিল সাইফুলের পরিবার।” 

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) মহাসচিব নূর খান বলেন, “শুধুমাত্র সন্দেহের কারণে মারা যাওয়ার পরও কোনো ক্ষতিপূরণ না পাওয়া খারাপ দৃষ্টান্ত। মানবাধিকারের জায়গা থেকে এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেয়া উচিত ছিল। যেহেতু রাষ্ট্র দায়বদ্ধতার জায়গায় নেই, সেহেতু এটা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।