ড্রোন দিয়ে জঙ্গি হামলার মূল পরিকল্পনাকারীসহ আটক ৩
2021.08.11
ঢাকা

পাঁচ বছর আগে ঢাকার হলি আর্টিজান বেকারিতে নৃশংস সন্ত্রাসী হামলা চালানো জঙ্গি সংগঠন নব্য-জামায়তুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (নব্য-জেএমবি) সামরিক শাখার প্রধান প্রশিক্ষক ও বোমা প্রস্তুতকারক জাহিদ হাসানসহ তিন সন্দেহভাজন জঙ্গিকে আটক করেছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট।
মোঃ জাহিদ হাসান ওরফে রাজু ওরফে ইসমাঈল হাসান ওরফে ফোরকানের সাথে আটক অপর দুইজন হলেন সাইফুল ইসলাম মারুফ ওরফে বাসিরা এবং মোঃ রুম্মান হোসেন ফাহাদ।
ওই তিনজনকে মঙ্গলবার ঢাকার কাফরুল এলাকা থেকে আটক করা হয় জানিয়ে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, ড্রোন ব্যবহার করে হামলার পরিকল্পনা ছিল জাহিদের।
আটকের পর তাঁদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা দায়ের করে বুধবার আদালতে উপস্থাপন করা হলে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রত্যেকের চার দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর হয় বলে বেনারকে জানান ঢাকা আদালতে পুলিশের প্রসিকিউশন বিভাগের উপকমিশনার জাফর হোসেন।
কে এই বোমা প্রস্তুতকারী জাহিদ?
মো. আসাদুজ্জামান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ২০১৬ সালে জাহিদ জঙ্গিবাদী কার্যক্রমে যুক্ত হয়। সে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় হতে রসায়নে স্নাতক (সম্মান) পাশ করেছে; তবে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী সম্পন্ন করেনি।
তিনি জানান, জাহিদ ২০১৬ সালে অনলাইনে ‘হোয়াইট হাউজের মুফতি’ নামক আইডি’র মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে নব্য জেএমবি’র তৎকালীন আমির মুসার হাত ধরে এই সংগঠনে যোগদান করে। আমির মুসার সাথে কাজ করার সুবাদে সংগঠনের ওই সময়ের শীর্ষস্থানীয় জঙ্গিদের নজরে আসে এবং তাদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে কাজ করে।
তিনি বলেন, “রসায়নে পারদর্শী হওয়ার কারণে তার মেধা এবং সাহসের জন্য তাকে এই সংগঠনের সামরিক শাখার সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।”
“রসায়নের ছাত্র হওয়ার সুবাদে সে অল্পদিনে গ্রেনেড ও বোমা বানানোয় অত্যন্ত দক্ষ হয়ে ওঠে এবং নিত্য নতুন কৌশলে আইইডি (ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) প্রস্তুত করে। এই সংগঠনের যারা বোমা ও গ্রেনেড তৈরি করত তাদেরকে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিত সে,” বলেন মো. আসাদুজ্জামান।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানের প্রেক্ষিতে জাহিদ আত্মগোপনে চলে যায় জানিয়ে তিনি বলেন, পরবর্তীতে “আবার সে নতুন আমিরের নেতৃত্বে সংগঠনকে সংগঠিত করার উদ্যোগ নেয়।”
জাহিদ অনলাইনে আইডি খোলার মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যারা অত্যন্ত সাহসী ও সামরিক বিভাগে কাজ করতে আগ্রহী তাদের মধ্য থেকে “বাছাইকৃত সদস্যদের বিভিন্ন ধরনের বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ দিত,” জানান আসাদুজ্জামান।
“সর্বশেষ সে ড্রোনের সাথে এক্সপ্লোসিভ যুক্ত করে আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিল” বলেন কাউন্টার টেররিজম প্রধান।
তিনি বলেন, জাহিদ সামরিক শাখার প্রধান নিযুক্ত হবার পর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, পুলিশ বক্সে হামলার পরিকল্পনার সাথেও জড়িত ছিল। এছাড়া আমিরের নির্দেশে যেসকল হামলার ঘটনা ঘটেছে সেসকল হামলায় জাহিদ সমন্বয়কের ভূমিকাও পালন করেছে।
আটক সাইফুল ইসলাম মারুফ জাহিদের কাছ থেকে অনলাইনে প্রশিক্ষণ নিয়েছে এবং সে এখন একজন দক্ষ বোমা তৈরি কারিগর জানিয়ে আসাদুজ্জামান বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সাইফুল বেশ কয়েকটি বোমা হামলার ঘটনায় তার সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছে।
তিনি জানান, আটক অপর অভিযুক্ত মোঃ রুম্মান হোসেন বাসা থেকে পালিয়ে সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে সামরিক প্রশিক্ষণ নেবার জন্য বান্দরবানে পালিয়ে ছিল।
সংগঠনের ফান্ড তৈরির জন্য ইলেকট্রিক শক থেরাপির মাধ্যমে লোকজনকে অজ্ঞান করে ছিনতাই ও ডাকাতি করার জন্য টঙ্গী থানাধীন রেলগেট এলাকায় রুম ভাড়া নেয় রুম্মান।
ড্রোন হামলার পরিকল্পনা: নতুন আশঙ্কা
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া বাংলাদেশে কেউ ড্রোন ব্যবহার করতে পারে না বলে বেনারকে জানান আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের পরিচালক আব্দুল্লাহ ইবনে জায়েদ।
“ড্রোন আমদানি করতেও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের অনুমতি প্রয়োজন হয়; আমদানির কারণও ব্যাখ্যা করতে হয়,” বলেন তিনি।
ড্রোন দিয়ে হামলার পরিকল্পনা নতুন হলেও বিশ্লেষকদের মতে বাংলাদেশে খুব সহজেই বিভিন্ন ধরনের ড্রোন পাওয়া যায়, জঙ্গিরা চাইলেই এগুলোর ক্ষমতা বৃদ্ধি করে বিস্ফোরক লাগিয়ে কোনো একটি স্থানে হামলা করার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
“ড্রোনের সাথে বিস্ফোরক লাগিয়ে কোনো একটি স্থানে বিস্ফোরণ ঘটানো খুবই সম্ভব। মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিরা ড্রোন ব্যবহার করে হামলা করেছে,” বেনারকে বলেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডোর ইশফাক ইলাহী চৌধুরী।
“তবে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ড্রোন দিয়ে জঙ্গি হামলার পরিকল্পনার কোনো ঘটনা আমরা জানতে পারিনি,” বলেন ইশফাক ইলাহী।
“বাংলাদেশে খুব সহজেই বিভিন্ন ধরনের ড্রোন পাওয়া যায়,” জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি বলব, ড্রোন বানানো এবং ড্রোনের ক্ষমতা বৃদ্ধি এখন প্রায় কুটির শিল্পে পরিণত হয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা এবং এমনকি স্বল্প জ্ঞান সম্পন্ন কারিগরও ড্রোনের ওজন পরিবহনের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারে।”
বর্তমানে “সারা বিশ্বেই ড্রোন দিয়ে হামলা করার একটি প্রবণতা জঙ্গিদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। এটিকে অনেকেই নতুন নিরাপত্তা ঝুঁকি হিসাবে চিহ্নিত করছেন,” বলে বেনারকে জানান অন্য নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ।
তাঁরও মতে, “ড্রোনের সাথে বিস্ফোরক বেঁধে কোনো সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা করা সম্ভব।”
বাংলাদেশে যে বাণিজ্যিক ড্রোন পাওয়া যায় সেগুলো খুব বেশি ওজন বহনে সক্ষম না হলেও জেনারেল রশীদের মতে, “ভয়ের বিষয় হলো, জঙ্গিরা যে কোনো সাধারণ বস্তুকে ইমপ্রুভাইজ করে বিপজ্জনক বস্তুতে পরিণত করতে পারে। আর যদি কোনো জঙ্গি বিজ্ঞান বিষয়ে পারদর্শী হয় তাহলে বিপদ আরও বেশি।”
তিনি বলেন, “তারা যদি সাধারণ ড্রোন ব্যবহার করে খুব ছোট আকারের আক্রমণ চালাতে সক্ষম হয় তাহলেও দেশে একটি ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারবে। কারণ জঙ্গিদের মূল উদ্দেশ্য হলো ভয় সৃষ্টি করা এবং কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা।”
“তবে কোনো ধরনের অঘটনের আগেই আমাদের কাউন্টার টেররিজম বিভাগ জঙ্গিদের ধরে ফেলছে। এর অর্থ হলো, আমাদের গোয়েন্দা ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা কাজ করছেন,” যোগ করেন জেনারেল রশীদ।