আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখল: বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ, পুলিশ সতর্ক
2021.08.18
ঢাকা

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ শুরু হয়েছিল মূলত আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশে ফিরে আসা জঙ্গিদের মাধ্যমেই। ইতিমধ্যে পুলিশ বলছে, আশির দশকের পর প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ থেকে যুবকেরা আবার আফগানিস্তানে জঙ্গি সংগঠনগুলোর পক্ষে যুদ্ধ করতে সেখানে যাচ্ছে।
“আফগানিস্তানের পরিস্থিতি বাংলাদেশকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে,” মন্তব্য করে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক একেএম শহিদুল হক মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “আশির দশকে বাংলাদেশ থেকে অনেক যুবক সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আফগানিস্তান গিয়েছিল। সেখানে তারা ভারী অস্ত্র ও গ্রেনেডের ব্যবহার শেখার পাশাপাশি তালেবান ও আল-কায়েদার কট্টর আদর্শে দীক্ষা নেয়।”
তিনি বলেন, “১৯৮৯ সালে সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তান থেকে চলে গেলে বাংলাদেশি জঙ্গি যারা জীবিত ছিল তারা দেশে ফিরে আসে। এদের মধ্যে অন্যতম ছিল শায়খ আব্দুর রহমান ও মুফতি হান্নান।”
“মুফতি হান্নান বাংলাদেশে হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামীকে সংগঠিত করে জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে। শায়খ আব্দুর রহমান জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) প্রতিষ্ঠা করে,” বলেন শহিদুল হক।
উল্লেখ্য, ২০০০ সালে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার জনসভাস্থলে ৭৬ কেজি বোমা পেতে রাখে মুফতি হান্নানের হরকাতুল জিহাদ। তবে বোমাটি বিস্ফোরিত হওয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বাহিনী সেটিকে নিষ্ক্রিয় করে।
২০০৪ সালের ২১ মে সিলেটে হযরত শাহ জালালের মাজারে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা চালায় হরকাতুল জিহাদ।
এই সংগঠনটি ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট পুনরায় বিরোধীদলীয় নেত্রী থাকা অবস্থায় শেখ হাসিনাকে প্রকাশ্য জনসভায় গ্রেনেড মেরে হত্যার চেষ্টা করে।
শায়খ আব্দুর রহমানের জেএমবি ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারাদেশে একযোগে ৬৩ জেলায় বোমা হামলা চালিয়ে দেশের প্রচলিত বিচার ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে।
২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল আনোয়ার চৌধুরীর ওপর আক্রমণের দায়ে মুফতি হান্নানের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
ঝালকাঠিতে দুই বিচারপতিকে হত্যার দায়ে ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ শায়খ আব্দুর রহমানসহ জেএমবি শীর্ষ নেতার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
এসব দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে শহিদুল হক বলেন, “মূলত আফগান ফেরতরাই বাংলাদেশে জঙ্গি কার্যক্রম শুরু করে। আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীকে পরাজিত করে বীরের বেশে দেশে ফিরে বাংলাদেশে তাদের মতো ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ শুরু করে।”
১৯৯২ সালে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আফগান ফেরত জঙ্গিরা স্লোগান দেয়, “আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান।”
শহিদুল হক বলেন, “ওই জেএমবি থেকেই তামিম চৌধুরী বাংলাদেশে ইসলামিক স্টেটের আদর্শে নব্য জেএমবি প্রতিষ্ঠা করে। তারা হলি আর্টিজানে রক্তাক্ত হামলা সংগঠিত করার পর আমরা তাদের নেটওয়ার্ক ধ্বংস করে দিয়েছিলাম।”
“সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ থেকে যুবকেরা আবার আফগানিস্তান যাচ্ছে। আর তালেবানের আফগানিস্তান দখলের পর বাংলাদেশের জঙ্গিরা মনে করছে আমেরিকাসহ বিশ্বের বড়ো বড়ো সামরিক শক্তিকে যদি তালেবানরা পরাজিত করতে পারে তাহলে বাংলাদেশে কথিত ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা তারা করতেই পারবে,” বলেন পুলিশের ওই সাবেক প্রধান কর্মকর্তা।
“বাংলাদেশি জঙ্গিদের মধ্যে যারা আফগান ফেরত তাদের প্রত্যেকের ওপর নজর রাখতে হবে। যারা পূর্বে জঙ্গিবাদের সাথে যুক্ত ছিল তাদের নজরে রেখে প্রয়োজনে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। এ ছাড়া অনলাইনে নজরদারি বৃদ্ধি করতে হবে,” বলেন তিনি।
আফগানিস্তান যাবার চেষ্টায় জঙ্গিরা
গত ১৪ আগস্ট ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “আফগানিস্তানে যুদ্ধে যাবার জন্য একটি আহবান জানানো হয়েছে তালেবানদের পক্ষ থেকে এবং বাংলাদেশ থেকে কিছু মানুষ অলরেডি তালেবানদের সাথে যুদ্ধে যোগদান করার জন্য হিজরত করেছে।”
তিনি বলেন, “কিছু মানুষ আমরা ধারণা করছি যে ইন্ডিয়ায় ধরা পড়েছে। কেউ কেউ পায়ে হেঁটে বিভিন্নভাবে আফগানিস্তানে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে।"
গত ৯ মে এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান আসাদুজ্জামান জানান, ৮ মে পুলিশের হাতে আটক আনসার আল-ইসলামের সদস্য মো. জসিমুল ইসলাম ওরফে জ্যাক, মো. আব্দুল মুকিত, মো. আমিনুল হক ও সজীব ইখতিয়ার প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আফগানিস্তানে যাওয়ার পরিকল্পনার কথা পুলিশকে জানায়।
কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের তৎকালীন উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম ১০ মে বেনারকে বলেন, “আল-কায়েদার অনুসারী আনসার আল-ইসলামে তাদের দুই সদস্য মার্চের কোনো এক সময়ে চট্টগ্রাম দিয়ে ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য হয়ে পাকিস্তান পার হয়ে আফগানিস্তান গেছে। তাদের নাম আব্দুর রাজ্জাক ও মো. শিব্বির।”
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমশের মবিন চৌধুরী বেনারকে বলেন, তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর সবচেয়ে বড়ো ঝুঁকি ও দেখার বিষয় হলো তারা আল-কায়েদাকে সমর্থন দেয় কিনা।
তিনি বলেন, “আল-কায়েদা যদি তালেবানের সমর্থন পায় সেক্ষেত্রে এই অঞ্চলের দেশগুলোর জন্য তা দুশ্চিন্তার কারণ হবে, বিশেষ করে ভারত এবং বাংলাদেশের জন্য। আল-কায়েদা ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্টে রয়েছে। তারা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করবে।”
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার বেনারকে বলেন, “তালেবানরা ক্ষমতায় পাকাপোক্ত হওয়ার পর পাকিস্তানের মাধ্যমে বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ রপ্তানি করতে পারে।”
তিনি বলেন, “তালেবানের ক্ষমতা দখলে বাংলাদেশের সকল জঙ্গি সংগঠন এবং তাদের সমর্থকরা ভীষণ উল্লসিত; কেউ কেউ ফেসবুকে তালেবানদের অভিনন্দন জানিয়ে পোস্ট দিয়েছে।”
তিনি বলেন, “সম্প্রতি আবার বাংলাদেশ থেকে যুবকেরা আফগানিস্তান যাওয়া শুরু করেছে। এরা তালেবানদের কাছ থেকে অস্ত্র, অর্থ এবং প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশে আসবে। এটি আমাদের জন্য অশনি সংকেত।”
মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী বলেন, “আমাদের যুবকেরা মধ্যপ্রাচ্য হয়ে পাকিস্তান যাবে এবং সেখান থেকে আফগানিস্তানে চলে যাবে। পাকিস্তান জঙ্গিদের পুরোপুরি সহায়তা দিয়ে যাবে।”
তিনি বলেন, “সুতরাং, আমাদের সরকারের উচিত হবে, সকল বিমানবন্দর, নৌ বন্দর, স্থলবন্দরে নজরদারি বৃদ্ধি করা। আমাদের গোয়েন্দা তৎপরতাও বহুগুণে বৃদ্ধি করতে হবে।”
নজরদারি বাড়ানো হয়েছে
পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ইতিমধ্যে তারা সতর্ক হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপত্র মো. ফারুক হোসেন বেনারকে বলেন, সন্দেহভাজনদের অনলাইন কার্যক্রমের ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। আফগানিস্তান পরিস্থিতির পর কিছু যুবক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় হয়েছে। তাদের ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
“তালেবানদের ক্ষমতা দখল বাংলাদেশে জঙ্গিদের উজ্জীবিত করতে পারে, এটা মাথায় রেখেই পুলিশের সাইবার ইউনিট, কাউন্টার টেররিজম ইউনিট এবং বিভিন্ন সংস্থা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অব্যাহত থাকবে এবং তাদের কঠোরভাবে দমন করা হবে,” জানান ফারুক হোসেন।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডোর ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বেনারকে বলেন, “এখন পর্যন্ত তালেবানের পক্ষ থেকে যা বলা হচ্ছে তা হলো তারা সবাইকে নিয়ে একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করবে। তারা বিদেশে সন্ত্রাসবাদ রপ্তানি করবে না। যদি তারা তাদের কথা অনুযায়ী কাজ করে তাহলে ভালো।”
“তবে তারা যদি সেটা না করে পূর্বের মতো কঠোর শাসন ব্যবস্থা চালু করে তাহলে বাংলাদেশসহ পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য বিরাট বিপদ অপেক্ষা করছে,” বলেন তিনি।
ইশফাক ইলাহী বলেন, “আমাদের দেশের জঙ্গি ও উগ্রবাদী সংগঠনগুলো প্রধানত তালেবানের ক্ষমতা দখল থেকে আদর্শিকভাবে বিশালভাবে উজ্জীবিত হবে।”
“বাংলাদেশ যদি তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়, সেক্ষেত্রে আমাদের যুবকেরা সেখানকার মাদ্রাসায় ভর্তি হবে, জঙ্গি প্রশিক্ষণ নেবে এবং দেশে ফিরে উগ্রবাদী কার্যক্রম পরিচালনা করবে,” যোগ করেন ইশফাক ইলাহী।