জুলহাজ-তনয় হত্যা: আসামিদের মৃত্যুদণ্ড চায় রাষ্ট্রপক্ষ, আসামিপক্ষ চায় খালাস
2021.08.23
ঢাকা

নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের কর্মীদের হামলায় নিহত এলজিবিটি অ্যাকটিভিস্ট জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব রাব্বী তনয় হত্যা মামলার যুক্তিতর্কে অভিযুক্ত আট আসামির মৃত্যুদণ্ডের দাবি জানিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। আর আসামিপক্ষ চেয়েছে সবার বেকসুর খালাস।
আগামী ৩১ আগস্ট এই হত্যা মামলার রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ হয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন উভয় পক্ষের আইনজীবী। টানা দুই দিন বাদী ও বিবাদী পক্ষের যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান সোমবার বিকেলে রায় ঘোষণার এই তারিখ নির্ধারণ করেন।
যুক্তিতর্কের শুনানিতে আট অভিযুক্তের মধ্যে চারজন; মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন (২৫), আরাফাত রহমান (২৪), মো. শেখ আব্দুল্লাহ (২৭) ও আসাদুল্লাহ ওরফে ফয়জুল (২৫) আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
বাকি চারজন সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক ওরফে জিয়া (৪২), আকরাম হোসেন (৩০), সাব্বিরুল হক চৌধুরী (২৪) ও জুনায়েদ আহম্মদ (২৬) পলাতক আছেন বলেও উল্লেখ করেছেন আইনজীবীরা।
“আদালতে আমরা মোট ২৪ জন সাক্ষী উপস্থাপন করেছি। আটক চার আসামি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। সব কিছু আদালতে যথাযথভাবে উপস্থাপন করে আশা করি আমরা অভিযুক্তদের অপরাধ প্রমাণ করতে পেরেছি,” বেনারকে বলেন এই মামলার রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলি গোলাম ছারোয়ার খান জাকির।
“রোববার রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি দাবির প্রেক্ষিতে সোমবার আসামিপক্ষ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছে। আমি তাদের সব বক্তব্যের জবাব দিয়ে আদালতে আবারো একই দাবি জানিয়েছি,” যোগ করেন তিনি।
অন্যদিকে সবার বেকসুর খালাস চাওয়ার কথা জানিয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী এম নজরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “রাষ্ট্রপক্ষের ২৪ জন সাক্ষীর কেউ তাদের কোপাতে দেখেছে, আবার কেউ অন্য কোনো প্রমাণ নিয়ে এসেছে। এর মধ্যে কোনো সাক্ষীই কিন্তু আদালতে জবানবন্দি দেওয়ার পরে দেখাতে পারেনি যে এই আসামিরাই ঘটনাটি ঘটিয়েছে।”
গ্রেপ্তার আসামিদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া মোবাইল, ল্যাপটপ, হার্ডডিক্স থেকেও তদন্তকারীরা এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত কোনো তথ্য উদঘাটন করতে পারেনি বলেও জানান তিনি।
রায় ঘোষণার তারিখ শোনার পর উপস্থিত আসামিরা এজলাস কক্ষ থেকে বেরিয়ে হাস্যোজ্জ্বলভাবে স্বজনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন। ছবি ও ভিডিও ধারণকালে উপস্থিত সাংবাদিকদের সাথে ঠাট্টা করারও চেষ্টা করেছেন তাঁরা।
আদালত প্রাঙ্গণে অভিযুক্ত সায়মনের বাবা আবু মোহাম্মদ হুসাইন বেনারকে বলেন, “রায়ে কী হবে তা আমরা আগেই জানি। মূলত পুত্রবধূ আর নাতনিকে ছেলের সাথে দেখা করাতেই আদালতে এসেছি।”
সায়মন গত ফেব্রুয়ারিতে একই আদালতের দেওয়া রায়ে বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায় হত্যা মামলা এবং প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত।
জুলহাজ-তনয় হত্যা মামলার অন্য আসামিদের মধ্যে আরাফাতকে অভিজিৎ এবং আবদুল্লাহকে দীপন হত্যার জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) ছারোয়ার। এ ছাড়া পলাতক জিয়া এবং আকরাম দুটো মামলাতেই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বলে তিনি জানান।
ওই দুটি হত্যা মামলার রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী নজরুল।
জুলহাজ-তনয়ের স্বজনদের ভাষ্য
রায় ঘোষণার তারিখ শোনার পর হত্যা মামলাটির বাদী জুলহাজের বড়োভাই মিনহাজ মান্নান ইমন বেনারকে বলেন, “তদন্ত বা বিচার চলাকালে সংশ্লিষ্ট কেউ আমাকে বা আমার পরিবারের সদস্যদের কখনো কিছু জানায়নি। শুধু একবার আদালতে সাক্ষী হিসেবে যেতে হয়েছে। এ নিয়ে ক্ষোভ থাকলেও আপাতত কোনো মন্তব্য করতে চাই না।”
তনয়ের মামা মাহফুজুর রহমান খান বেনারকে বলেন, “আমরা অবশ্যই চাই দোষীদের কঠোরতম শাস্তি হোক। তবে এই মামলার মূল দুই আসামিই কিন্তু পলাতক। বিশেষ করে আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার প্রধান চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াকে না ধরা হলে যে রায়ই আসুক তা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।”
“কারণ যারা ধরা পড়েছে তারা সবাই আসলে মাঠকর্মী, শুধু হুকুম তামিল করেছে। কিন্তু যারা ‘মাস্টারমাইন্ড’ বা হুকুমদাতা তাদের যতক্ষণ ধরা না যাবে, ততদিন বিচারের সুফল পাওয়া যাবে না। চারজনকে ফাঁসি দেওয়ার বদলা নিতে তারা ৪০ জনকে তৈরি করে ফেলবে,” যোগ করেন তিনি।
রাজধানীর কলাবাগান লেক সার্কাস এলাকার ৩৫ নম্বর বাসা আছিয়া নিবাসের দ্বিতীয় তলায় ২০১৬ সালে খুন হন জুলহাজ-তনয়। সাহায্য সংস্থা ইউএসএআইডির কর্মকর্তা জুলহাজ এর আগে বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনার প্রটোকল কর্মকর্তা হিসেবেও কর্মরত ছিলেন। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্র তনয় লোক নাট্যদল এবং তাদের শিশু সংগঠন পিপলস থিয়েটারের সঙ্গে ছিলেন।
তারা দুজনেই ২০১৪ সালে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশের প্রথম সমকামী ও তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার বিষয়ক পত্রিকা ‘রূপবান’ প্রকাশ ও প্রচারের সাথে জড়িত ছিলেন।
মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম (সিটি) ইউনিটের কর্মকর্তারা ২০১৯ সালের এপ্রিলে বেনারকে বলেছিলেন, ‘রূপবান’ প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত থাকায় আনসার আল ইসলাম (সাবেক আনসারুল্লাহ বাংলা টিম–এবিটি) জুলহাজকে হত্যার পরিকল্পনা নেয়।
ওই বছরের মে মাসেই আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন ওই ইউনিটের পরিদর্শক মুহম্মদ মনিরুল ইসলাম।
এর আগে ঘটনার রাতেই জুলহাজের বড়ো ভাই অজ্ঞাতপরিচয় পাঁচ-ছয়জনকে আসামি করে কলাবাগান থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ ছাড়া পুলিশের ওপর হামলা ও অস্ত্র পাওয়ার ঘটনায় আরেকটি মামলা করেন থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শমীম আহমেদ।
এজাহারের তথ্য অনুযায়ী, পার্সেল ডেলিভারির কথা বলে কয়েকজন যুবক বাসায় ঢুকে কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুজনকে কুপিয়ে হত্যা করে। জুলহাজের মরদেহ বেডরুমে এবং তনয়ের মরদেহ ড্রইংরুমে পাওয়া যায়। তাঁদের চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
খুনিরা পালানোর সময় বাড়ির দারোয়ান পারভেজ মোল্লা এবং কলাবাগান এলাকায় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মমতাজউদ্দিনও হামলার শিকার হন। তবে মমতাজ দুর্বৃত্তের একজনকে জাপটে ধরে একটি ব্যাগ রেখে দিতে সক্ষম হন।
ওই ব্যাগে থাকা হত্যাকারীরা একটি পিস্তল, একটি দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র, গুলি ও মুঠোফোনের সূত্র ধরেই তদন্ত এগিয়েছে।
এর আগে হত্যাকাণ্ডের পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট (তৎকালীন) বারাক ওবামা বিচারের দাবি জানিয়েছিলেন এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিচারের আশ্বাসও দিয়েছিলেন।