গুলশান হামলার অপারেশন কমান্ডার মারজানসহ দুজন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত
2017.01.06

গুলশান হামলার তদন্ত শুরুর পর পরই পুলিশ গণমাধ্যমে মারজানের নাম ও ছবি প্রকাশ করেছিল। এরপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময়ে মন্তব্য করেন যে, মারজান গোয়েন্দা নজরদারিতে আছে। ওইসব বক্তব্যের পর থেকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ওই যুবক আছে কিনা, সেই জল্পনা–কল্পনা শুরু হয়।
গত কয়েকমাস ধরে চলা সেসব জল্পনা–কল্পনার অবসান ঘটিয়ে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে রাজধানীতে নিহত হয়েছেন জঙ্গিনেতা নুরুল ইসলাম মারজানসহ দুজন। গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোঁরার হামলায় এই মারজান ‘অপারেশন কমান্ডার’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন বলে দাবি করে আসছে পুলিশ।
পুলিশি অভিযানে জঙ্গি নিহত হওয়ার পর পরই সাধারণত পুলিশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি গণমাধ্যমকে জানানো হয়। কিন্তু ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারজান ও সাদ্দাম নিহত হওয়ার বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি।
এরই মধ্যে গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর আজিমপুরে জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার হন মারজানের স্ত্রী আরেফিন প্রিয়তি। আর সাদ্দামকে গত বছরের ১৪ এপ্রিল গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে তার শ্বশুরবাড়ি থেকে পুলিশ পরিচয়ধারী লোকজন তুলে নিয়ে গিয়েছিল বলে দাবি করেছে তার পরিবার।
ডিএমপির গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান মুঠোফোনে এক খুদে বার্তায় সাংবাদিকদের জানান, রাত সাড়ে তিনটার দিকে বন্দুকযুদ্ধে মারজানসহ দুজন নিহত হন। এ ঘটনায় পুলিশের চার সদস্যও আহত হয়েছেন।
কাউন্টার টেররিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের উপপ্রধান মহিবুল ইসলাম বেনারকে বলেন, মারজান মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকার কাছাকাছি কোথাও আছে, এমন একটা খবর ছিল। সে কারণে পুলিশ নিরাপত্তা চৌকি বসায়।”
ওই কর্মকর্তা জানান, রাত তিনটার দিকে একটি মোটরসাইকেল বেড়িবাঁধ এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ সেটিকে থামতে বলে। কিন্তু মোটর সাইকেলটি না থেমে পুলিশকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। পুলিশও তাদের গুলি করে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর তাদের মৃত ঘোষণা করা হয়।
পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরায় হামলার পর থেকে পুলিশের অভিযানে হামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১৩ জঙ্গি নিহত হয়েছে। ওই দিনের পর এ পর্যন্ত মোট নিহত জঙ্গির সংখ্যা ৩৪।
বন্দুকযুদ্ধে মারজান ও সাদ্দাম নিহত হওয়ার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল রাজধানীর ধানমন্ডিতে নিজ বাসায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেছেন, মারজান ও সাদ্দামকে অনেক দিন ধরে খোঁজা হচ্ছিল। দুজনই ধরা পড়ে নিহত হয়েছে।
“কেউ বাদ যাবে না। মুসাও বাদ যাবে না। এরা শিগগিরই ধরা পড়বে। বাংলাদেশে পালিয়ে থাকার কোনো সুযোগ তাদের থাকবে না। কোনো জঙ্গিই রেহাই পাবে না,” বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
নুরুল ইসলাম মারজানের বাড়ি পাবনা সদর উপজেলার হেমায়েতপুর ইউনিয়নের আফুরিয়া গ্রামে। তার বাবা নিজাম উদ্দিন গেঞ্জির কারিগর। দশ ভাই-বোনের মধ্যে মারজান দ্বিতীয়। গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করে মারজান পাবনা শহরের পুরাতন বাঁশবাজার আহলে হাদিস কওমী মাদ্রাসায় ভর্তি হয়।
একইসঙ্গে পাবনা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে জিপিএ-৫ পেয়ে দাখিল ও আলিম পাস করে। ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগে ভর্তি হয় মারজান। গত জানুয়ারিতে শেষবারের মতো বাড়ি গিয়ে খালাতো বোন প্রিয়তিকে বিয়ে করে। এরপর স্ত্রীসহ বাড়ি ছাড়ে। পরিবারের সঙ্গে তার আর যোগাযোগ হয়নি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মোহাম্মদ আলী আজগর চৌধুরী বেনারকে বলেন, “নুরুল ইসলাম শিবিরের সাথি ছিল। ২০১৫ সালের ৯ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবদুর রব ছাত্রাবাসে পুলিশ তল্লাশি চালায়। এ সময় একটি ল্যাপটপ জব্দ করা হয়। ওই ল্যাপটপে শিবিরের সাথির তালিকায় নুরুল ইসলামের নাম পাওয়া যায়।”
‘অপারেশন কমান্ডার’ মারজান
গত ১২ আগস্ট ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে এক ব্রিফিং করে পুলিশ তাদের ‘হ্যালো সিটি’ অ্যাপের মাধ্যমে মারজানের বিষয়ে তথ্য জানানোর জন্য আহ্বান জানিয়ে তার ছবি প্রকাশ করে। সেখানে তাঁকে গুলশান হামলার ‘অপারেশন কমান্ডার’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
ওইদিন ব্রিফিংয়ে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগের প্রধান (সিটি) মনিরুল ইসলাম বলেন, হলি আর্টিজানে হামলাকারীরা হামলা ও হত্যার সব ছবি মারজানের আইডি থেকেই বাইরে পাঠায়।
২ সেপ্টেম্বর আরেক সংবাদ সম্মেলনে মনিরুল ইসলাম বলেন, তামিম চৌধুরীর পর নব্য জেএমবির গুরুত্বপূর্ণ নেতা হলেন মারজান। মারজানের ওপর নির্ভরতা ছিল তামিমের।
মারজানের মৃত্যুতে দুঃখ পাননি বলে বক্তব্য দিয়েছেন তার বাবা। বাবা নিজামউদ্দীন বেনারকে বলেছেন, “মারজান কৃতকর্মের ফল পেয়েছে। এতে বাবা হিসেবে আমার কোনো দুঃখ নেই।”
“লাশ ঢাকা থেকে গ্রামে নেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই। প্রশাসন যদি লাশ গ্রামে পৌঁছে দেয় সেক্ষেত্রে দাফনের ব্যবস্থা করব,” জানান নিজামউদ্দীন।
সাদ্দামকে আগেই তুলে নেওয়া হয়!
পুলিশে জানিয়েছে, গতকালের বন্দুকযুদ্ধে নিহত অপরজন সাদ্দাম হোসেন। রংপুরের জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিসহ উত্তরাঞ্চলে একাধিক জঙ্গি হামলা ও হত্যাকাণ্ডে সে জড়িত ছিল। সে পাঁচটি হত্যা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি এবং আরও পাঁচটি হত্যা ও হত্যা চেষ্টা মামলারও আসামি।
সাদ্দামের বাড়ী কুড়িগ্রাম রাজাহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের চর বিদ্যানন্দে। তার বাবা তাজুল আলম মিয়া (আলম জোলা) পেশায় কৃষক। ছয় ভাই এক বোনের মধ্যে সাদ্দাম পঞ্চম। তার স্ত্রী ফারহানা আখতার (১৭)। শ্বশুর বাড়ি গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার গোপালচরণ গ্রামে। সাদ্দাম তার শ্বশুর বাড়িতেই থাকত।
সাদ্দামের বাবা তাজুল ইসলামের দাবি, ৯ মাস আগে সাদা পোশাকে কে বা কারা শ্বশুর বাড়ি থেকে সাদ্দামকে ধরে ধরে নিয়ে যায়।
সাদ্দামের ভাই মিজানুর বেনারকে জানান, “রাজারহাট থানায় গিয়েছিলাম ভাইয়ের খোঁজে। পুলিশ বলেছে তারা জানে না। জিডি করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পুলিশ নেয়নি।”
অবশ্য স্থানীয় পুলিশ গণমাধ্যমের কাছে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
পরিবারের সদস্যরা জানান, সাদ্দাম কাউনিয়া উপজেলার চর তাম্বুলপুর দাখিল মাদ্রাসা থেকে দাখিল ও পাওটানা ফাজিল মাদ্রাসা থেকে আলিম পাশ করার পর লালমনিরহাট সরকারি কলেজে ভর্তি হয়। পুলিশ পরিচয়ে সাদ্দামকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ৩ মাস পরে তার একটি ছেলে সন্তান জন্ম নেয়। বর্তমানে সাদ্দামের স্ত্রী ও সন্তান কোথায় আছে, তা তাদের জানা নেই।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন জেসমিন পাপড়ি