হলি আর্টিজানে হামলা মামলার পলাতক আসামি রিপন গ্রেপ্তার
2019.01.20
ঢাকা

গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি মামনুর রশীদ ওরফে রিপনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। শনিবার রাত সোয়া ১১টায় গাজীপুরের বোর্ড বাজার এলাকার একটি বাস থেকে র্যাব–৩ এর আভিযানিক একটি দল তাকে গ্রেপ্তার করে।
গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনায় জীবিত আটজনকে আসামি করে পুলিশ অভিযোগপত্র জমা দিয়েছিল। তাদের মধ্যে শরিফুল ইসলাম খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন পলাতক ছিল। রিপন গ্রেপ্তারের পর এই মামলায় চার্জশিটভুক্ত আর একজন আসামি পলাতক থাকল। হলি আর্টিজানে হামলার আগেই খালেদ ও রিপন ভারতে পালিয়ে যায় এমন তথ্য ছিল পুলিশের কাছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, শিগগিরি খালেদও ধরা পড়বে।
“খালেদকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। সে আর পালিয়ে থাকতে পারবে না,” আসাদুজ্জামান খান কামাল বেনার নিউজকে বলেন।
রোববার কারওয়ানবাজারের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র্যাব জানায়, হলি আর্টিজানে হামলার আসামিদের ছিনিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল মামুনুর রশিদ ওরফে রিপন।
বাহিনীটি আরও জানায়, হলি আর্টিজান হামলার আগে রিপন আনুমানিক ৩৯ লাখ টাকা নব্য জেএমবির অন্যতম শীর্ষ নেতা সারোয়ার জাহানকে পাঠায়। সে হলি আর্টিজান হামলার পরিকল্পনা ও অস্ত্র সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত ছিল বলেও স্বীকারোক্তি দিয়েছে।
তবে ঠিক কবে রিপন বাংলাদেশে এসেছে সে ব্যাপারে বিস্তারিত জানায়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীটি।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, রিপন হলি আর্টিজানে হামলায় অর্থ, অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহকারী। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে এ কথা স্বীকার করেছে। আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে রিপনকে।
“মোঃ মামুনুর রশিদ ওরফে রিপন ওরফে রেজাউল করিম ওরফে আবু মুহাজিরের (৩০) কাছ থেকে একটি ডায়েরি, চারটি খসড়া মানচিত্র এবং নগদ এক লাখ ৪৭ জাহার ৭৫৫ টাকা উদ্ধার করেছে,” মুফতি মাহমুদ খান বলেন।
আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি আরও বলেন, রিপন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে ২০১৪ সালে ত্রিশালে যেভাবে জঙ্গি ছিনতাই হয়েছিল, সে স্টাইলে হলি আর্টিজানের আসামিদের ছিনিয়ে নেওয়ার একটা পরিকল্পনা ছিল তাদের।
২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা চালায় আইএসপন্থী জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবি। ওই হামলায় দুজন পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২২ জন নিহত হন। এ বছরের ৩ ডিসেম্বর থেকে হলি আর্টিজানে হামলা মামলার বিচার শুরু হয়।
কে এই মামুনুর রশিদ?
গ্রেপ্তারের পর র্যাব কথা বলেছে রিপনের সঙ্গে। তার জন্ম, বেড়ে ওঠা ও জঙ্গিবাদে জড়িত হওয়া নিয়ে সে যেসব তথ্য দিয়েছে র্যাব সেসব তথ্য সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ করে।
গ্রেপ্তারকৃত জঙ্গি মামনুর রশীদ ওরফে রিপনের জন্ম ১৯৮৮ সালে বগুড়ায়। প্রথমে স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল রিপন। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়ার পর মাদরাসায় ভর্তি হয় রিপন। সে ঢাকার মিরপুর, বগুড়ার নন্দীগ্রাম ও নওগাঁর বিভিন্ন মাদরাসায় লেখাপড়া করেছে। সবশেষ ২০০৯ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মাদরাসাতুল দারুল হাদিস থেকে দাওরা-ই হাদিস শেষ করে বগুড়ার সাইবার টেক নামের একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যোগ দেয়।
এই প্রতিষ্ঠান থেকেই জঙ্গিবাদের হাতেখড়ি হয় রিপনের।
চিকিৎসক নজরুল ইসলাম রিপনকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করেছে বলে জানিয়েছে র্যাব। আগে ‘রশিদ’ নামে পরিচিত হলেও, ডা. নজরুল ইসলামই তার নাম রাখেন রিপন। প্রাথমিকভাবে রিপন শুধু চাঁদা সংগ্রহ করত। তারপর সেই টাকা পৌঁছে দিত জেএমবির একাংশের আমীর নজরুল ইসলামের কাছে। নজরুলের আস্থাভাজন হিসেবে সে অল্প সময়ের মধ্যে (জেএমবির ওই অংশের) সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
এক পর্যায়ে আমির হিসেবে নজরুল ইসলামের স্থলাভিষিক্ত হয় সারোয়ার জাহান। দায়িত্ব নিয়েই সে সংগঠনের জন্য নতুন করে অর্থ সংগ্রহ ও দাওয়াতী কার্যক্রম বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। এরই অংশ হিসেবে মামুনুর রশিদ ওরফে রিপনকে একটি নির্দিষ্ট এলাকার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
র্যাব জানায়, নির্দেশ মতো রিপন বিকাশের দোকান লুট করে ৬ লাখ টাকা, সিগারেট বিক্রেতার কাছ থেকে ১ লাখ টাকা এবং গাইবান্ধায় অপর এক ঘটনায় ১ লাখ টাকাসহ মোট আট লাখ টাকা লুট করে জেএমবির আমীর সারোয়ার জাহানের কাছে পৌঁছে দেয়। ক্রমশ নব্য জেএমবির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে রিপনের।
২০১৫ সালের মাঝামাঝিতে নব্য জেএমবির সাংগঠনিক কাঠামো চূড়ান্ত হয়। যে বৈঠকে ওই কাঠামো চূড়ান্ত হয় সেখানে রিপন উপস্থিত ছিল। ওই বৈঠকেই মামুনুর রশীদ ওরফে রিপন শুরা সদস্য মনোনীত হয়। জেএমবির প্রতিষ্ঠাকালীন আমির আব্দুর রহমানের মেয়ের জামাই আওয়ালের ভাগ্নে হওয়ায় রিপনের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে সংগঠনে।
রিপনের ভূমিকা
জিজ্ঞাসাবাদে রিপন জানিয়েছে, ২০১৬ সালের ২৩ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী খুন হওয়ার পরপরই খালেদ ও রিপন ভারতে পালিয়ে যায়। শরিফুল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক খুনের ঘটনায় চার্জশিটভুক্ত আসামি।
হলি আর্টিজানে হামলা পরিকল্পনা ও অস্ত্র সরবরাহের কাজে রিপন যুক্ত ছিল। এ ছাড়া উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জঙ্গি হামলা তার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে হয়। ওসব হামলার নেতৃত্বে ছিল জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী। বিভিন্ন জঙ্গি হামলার আগে তারা মহড়া করেছে এমন তথ্যও পাওয়া গেছে। এ ধরনের একটি মহড়ায় ২০১৬ সালে বগুড়ায় শুরা সদস্য ফারদিন ও অপর এক সক্রিয় জঙ্গি সদস্য তারিকুল ইসলাম ওরফে জুয়েল নিহত হয়।
গতকাল র্যাব রিপনকে সবুজবাগ থানায় হস্তান্তর করে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দায়ের হওয়া একটি মামলায় রিপনকে আদালতে উপস্থাপনের পর আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে।