জেএমবির পলাতক আমির সালাউদ্দিন: ভারত চষে বেড়ালেও অধরা
2020.02.05
ঢাকা ও কলকাতা

নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) এর শীর্ষ নেতা ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সালাউদ্দিন সালেহীন গা ঢাকা দিয়ে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে সাংগঠনিক তৎপরতা চালালেও তাঁকে ধরা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন দেশটির কর্মকর্তারা।
সংবাদ মাধ্যমে কথা বলার দায়িত্বপ্রাপ্ত নন জানিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভারতের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার (এনআইএ) এক কর্মকর্তা বুধবার বেনারকে বলেন, “সালাউদ্দিন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অঞ্চলের জেলাগুলিতে লুকিয়ে রয়েছে। নাম ও পেশা পরিবর্তন করে কোচবিহার, উত্তর দিনাজপুর, মালদহ, মুর্শিদাবাদ ও নদিয়ার বিভিন্ন গ্রামে সে গা ঢাকা দিয়ে থাকছিল বলে এনআইএ জানতে পেরেছে।”
“তিনবার তিন জায়গায় হানা দিয়েও তাঁকে ধরা যায়নি। তল্লাশির আগে সে সরে পড়েছে,” যোগ করেন ওই কর্মকর্তা।
জেএমবির বর্তমান আমির সালাউদ্দিন বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশেই ‘ওয়ান্টেড’ তালিকাভুক্ত আসামি। ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ময়মনসিংহের আদালতে এক মামলায় হাজিরা দিতে যাওয়ার সময় ত্রিশালে প্রিজনভ্যানে গুলি ও বোমা হামলা চালিয়ে জেএমবি সদস্যরা তাঁকে ছিনিয়ে নেয়। ওই ঘটনায় একজন পুলিশ নিহত হন।
এর কিছুদিন পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিশ্চিত হয় সালাউদ্দিন সালেহীন ভারতে পালিয়ে গেছেন।
“সালাউদ্দিনের কয়েকজন সহযোগীকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে সালাউদ্দিনের দক্ষিণ ভারতের কার্যক্রম সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা গেছে,” বুধবার বেনারকে বলেন কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের (এসটিএফ) এক কর্মকর্তা।
গণমাধ্যমে কথা বলার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত নন বলে তিনিও তাঁর নাম কিংবা পদবি প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা জানান, “কেরালা, কর্ণাটক ও তামিলনাডুর বাঙালি অধ্যুষিত শ্রমিক মহল্লায় সে বেশ কিছুদিন ডেরা তৈরি করে ছিল। সেখানে সে জেএমবির মডিউল তৈরির কাজ করে।”
ঢাকায় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম বেনারকে জানান, ভারতে সালাউদ্দিনের তৎপরতার খবর তাঁদের কাছে রয়েছে।
“সালাউদ্দিন সালেহীন ভারতের বিভিন্ন জায়গায় জঙ্গিসংগঠন বিস্তারের কাজে যুক্ত রয়েছেন। এদেশেও তাঁর কিছু অনুসারী আছে, তাঁদের সঙ্গে সালাউদ্দিনের যোগাযোগ আছে,” বলেন সাইফুল ইসলাম।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর সালাউদ্দিন জেএমবিকে একটি আঞ্চলিক রূপ দিতে চেয়েছিলেন। এখন এই সংগঠনের নাম জামায়াতুল মুজাহিদীন ইন্ডিয়া বা জেএমআই।
এর আগে ২০১৭ সালের জুলাই জামায়াতুল মুজাহিদীন এর মুখপাত্র (সাহাম আল হিন্দ) সালাউদ্দিনের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে। ওই সাক্ষাৎকারে সালাউদ্দিন বলেন, তাঁরা সংগঠনটিকে একটি পর্যায়ে নিতে পেরেছেন।
“হিন্দুস্থান যেন হিযরতের এবং জিহাদের কেন্দ্র হয়ে ওঠে, খিলাফা প্রতিষ্ঠায় যেন ভারতীয়রাও অংশ নিতে পারে সেটাই তাদের লক্ষ্য,” ওই সাক্ষাৎকারে বলেন সালাউদ্দিন।
বাংলাদেশ পুলিশের সূত্র জানায়, নারায়ণগঞ্জ জেলার রফিকুল ইসলামের ছেলে সালাউদ্দিন সালেহীন উচ্চমাধ্যমিকের পর ঢাকার তেজগাঁও পলিটেকনিক কলেজে ভর্তি হন।
তিনি প্রথমে ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও পরে শায়খ আবদুর রহমানের নেতৃত্বে জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের মজলিশে শুরার সদস্য হন। পরিবারের সঙ্গেও সম্পর্কচ্ছেদ করেন।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে র্যাব কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে ছাপা প্রতিবেদনে বলা হয় জেএমবির গঠন প্রক্রিয়ার শুরু ১৯৯৯ সালে। সালাউদ্দিন জেএমবির শুরু থেকেই সংগঠনটির সাথে যুক্ত বলে জানায় পুলিশ সূত্র।
দুই দেশেই ওয়ান্টেড
বর্ধমানের খাগড়াগড়ে ২০১৪ সালের অক্টোবর বিস্ফোরণ ও ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে বিহারের বুদ্ধগয়ায় হামলায় সালাউদ্দিন সালেহীনের সম্পৃক্ততার খবর প্রকাশ হয় তাঁর সহযোগীদের গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে।
২০১৮ সালের আগস্টে ভারতের কর্ণাটকে গ্রেপ্তার হন তাঁর প্রধান সহযোগী জাহিদুল ইসলাম মিজান ওরফে বোমারু মিজান।
২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই মিজানকেও সালাউদ্দিনের সাথে ত্রিশালে প্রিজনভ্যানে হামলা চালিয়ে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। মিজানের কাছ থেকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ছাড়াও পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম কর্মকর্তারা সালাউদ্দিন সালেহীন সম্পর্কে তথ্য পান।
ওই প্রিজন ভ্যান হামলায় ছিনিয়ে নেওয়া অন্য আসামি রকিবুল হাসান ঘটনার দিনই পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার ও পরে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন।
ভারতের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার (এনআইএ) তালিকায় সালাউদ্দিন সালেহীন ওয়ান্টেড। সংস্থাটির ওয়েবপেজে তাঁর তথ্য জানানোর অনুরোধ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে সালাউদ্দিন সালেহীন ছাড়াও তিনি হাফিজুর রেহমান শেখ ওরফে মাহিন নামে পরিচিত। তাঁকে ধরিয়ে দিতে পাঁচ লাখ রুপি পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়।
পুলিশ সদরদপ্তরের তথ্য কর্মকর্তা কামরুল আহসান নিশ্চিত করেছেন, সালাউদ্দিন সালেহীন বাংলাদেশেও মোস্ট ওয়ান্টেড।
“সালাউদ্দিন সালেহীনকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা হয়েছিল আগেই, ২০১৬ সালেই। এখনও এই ঘোষণা জারি আছে,” বলেন কামরুল আহসান।
র্যাব চট্টগ্রামের পাহাড়তলি থেকে ২০০৬ সালের এপ্রিলে সালাউদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে।
র্যাবের হাতে গ্রেপ্তারের পর সালাউদ্দিন জানান, তখন তিনি জেএমবির ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোণা ও কিশোরগঞ্জ এর দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন।
জিজ্ঞাসাবাদে সালাউদ্দিন জানান, তিনি ২০০৪ সালে জামালপুরে খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের নেতা গণি গোমেজ ও ২০০৫ সালে একই জেলার সরিষাবাড়ি উপজেলার ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান হৃদয় রায়কে হত্যা করেন। হৃদয় অভিনয় করে যিশুর বাণী প্রচার করতেন।
হৃদয় হত্যার ঘটনায় ২০১৩ সালে হাইকোর্ট সালাউদ্দিন সালেহীনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন। পুলিশ সদরদপ্তরের তথ্যমতে, সারাদেশে সালাউদ্দিনের নামে ৪০টিরও বেশি মামলা রয়েছে।
২০০৫ সালে জেএমবিকে নিষিদ্ধি করে বাংলাদেশ সরকার। ওই বছরের ১৭ আগস্ট সারাদেশের ৬৩টি জেলায় একযোগে বোমা হামলা চালায় সংগঠনটি।
পুলিশ সদরদপ্তরের অতিরিক্ত সহকারী মহাপরিদর্শক কামরুজ্জামান বলেন, বোমা হামলার ঘটনায় সালাউদ্দিন সালেহীনসহ প্রায় সাতশজন আসামি ছিলেন।
“ওই ঘটনায় সারাদেশে ১৫৯ টি মামলা হয়, সাজা হয় ৩৩৪ জনের। বিচারাধীন ৫২ মামলায় আসামি ৩৮৬ জন,” বেনারকে বলেন কামরুজ্জামামান।
এর বাইরেও সালাউদ্দিন সালেহীনের নামে দেশের বিভিন্ন থানায় ৪০টি মামলা আছে বলে জানান কামরুজ্জামামান।