হিন্দু মন্দিরে হামলার পরিকল্পনাকারী পাঁচ জঙ্গি রিমান্ডে
2020.02.10
ঢাকা

হিন্দু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস (ইসকন) বা আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের মন্দির ও অন্যান্য স্থাপনায় হামলার প্রস্তুতিকালে আটক পাঁচ জঙ্গিকে সোমবার চার দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত।
রাজধানীর সবুজবাগের বালুর মাঠ এলাকা থেকে রোববার বিকেলে তাঁদের গ্রেপ্তার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম এন্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) বিভাগ।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে পুলিশ বলছে, এই পাঁচজন নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের অনুসারী।
ঢাকার মিন্টো রোডে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সোমবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (সিটিটিসি) মো. ইলিয়াছ শরীফ জানান, নিষিদ্ধ ওই সংগঠনের মধ্যপ্রাচ্য ফেরত দুই নেতার নির্দেশে ইসকন মন্দির ও ইসকনের অন্যান্য স্থাপনায় হামলার পরিকল্পনা করা হয়।
“সংগঠনের আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য তাঁরা প্রশিক্ষণ নিয়ে নাশকতা ঘটানোর উদ্দেশ্যেই দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকায় এসে একত্রিত হন,” গ্রেপ্তারকৃতদের সম্পর্কে বলেন ইলিয়াছ শরীফ।
এর আগে গ্রেপ্তার হওয়া আনসার আল ইসলামের আরও তিন জঙ্গি ইসকনে হামলার পরিকল্পনার কথা স্বীকার করেছিলেন বলেও জানান সিটিটিসির এই কর্মকর্তা।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের সর্ববৃহৎ সংগঠন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক রানা দাশ গুপ্ত বেনারকে বলেন, “রামকৃষ্ণ মিশনসহ হিন্দুদের অন্যান্য যেসব ধর্মীয় সংগঠন এখানে সক্রিয় আছে, তাদের চেয়ে ইসকনের কর্মকাণ্ড অনেক বেশি সরব এবং দৃশ্যমান। মূলত এ কারণেই জঙ্গিরা তাদের ‘টার্গেট’ করেছে।”
“ইসকনের কর্মকাণ্ড দেখে তারা মনে করছে, এখানকার হিন্দুদের মধ্যে একটা ধর্মীয় জাগরণ ঘটছে। যে কারণে তারা ইসলামী উগ্রবাদীদের চক্ষুশূল হয়ে গেছে,” বলেন তিনি।
ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট, ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিসের (আইসিএলডিএস) নির্বাহী পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ বেনারকে বলেন, “জঙ্গিরা স্বভাবতই ওই সব কৌশলগুলো বেছে নেয়, যেগুলোয় বেশি প্রচার পাওয়া যায়। লক্ষ্যবস্তুও এভাবেই নির্ধারণ করে তারা।”
গত ২৮ অক্টোবর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করে ইসকনের মঠ-মন্দিরে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়। ইসকনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও গুজব রটানো হচ্ছে— বলেও দাবি করেছিলেন ইসকন বাংলাদেশের নেতারা।
যেভাবে ‘টার্গেট’ ইসকন
আগামী মার্চের ১২-১৬ তারিখ চট্টগ্রামে ইসকনের বড় অনুষ্ঠান হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে সারা দেশের হাজার হাজার ভক্তকে সমবেত করতে চাইছে ইসকন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকেও তাদের সন্যাসীদের আসার কথা।
“সম্ভবত ওটাকে ভণ্ডুল করার জন্যই এখন থেকে নানা চক্রান্ত হচ্ছে,” বেনারকে বলেন রানা দাশগুপ্ত।
তাঁর দাবি, ইসকন মুসলমানদের প্রসাদ খাইয়েছে এমন গুজব ছড়িয়ে আজ থেকে কয়েক মাস আগে (গত জুলাইতে) চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির পাঁয়তারা হয়েছিল। এরপর থেকেই একটি গোষ্ঠী ইসকনকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানায়।
“সরকার যদি সতর্ক না হয়, এগুলোকে কঠোরভাবে দমন না করে; তাহলে তারা এমন কোনো বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারে, যা রাষ্ট্র, রাজনীতি, সমাজ, কারও জন্যই খুব একটা সুখকর হবে না,” বলেন তিনি।
সর্বশেষ গত সপ্তাহে বাংলা একাডেমির অমর একুশে বইমেলা থেকে ইসকনের স্টল বাতিলের দাবি জানিয়ে পৃথক বিবৃতি দিয়েছেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব ও হাটহাজারী মাদ্রাসার সহযোগী পরিচালক আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী।
মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ও বাংলা একাডেমির পরিচালক ড. জালাল আহমেদ বেনারকে বলেন, “অনেক বছর ধরেই ইসকন মেলায় স্টল নিচ্ছে। এর আগে কখনো এ নিয়ে কেউ আপত্তি তোলেনি।”
নিরাপত্তা বিশ্লেষক আব্দুর রশীদ বলেন, “বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক ইসলামী সংগঠনগুলো প্রকাশ্যে সমর্থন না করলেও জঙ্গি সংগঠনগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয় বা রাজনৈতিক সুরক্ষা প্রদান করে। এই যোগসাজশের বিষয়টি নতুন নয়। কারণ দুই পক্ষের দর্শনই এক ও অভিন্ন।”
“যে কারণে ইসলামী সংগঠনগুলো ইসকন ইস্যুটি উত্থাপনের পর জঙ্গিরাও সেটাকে সাদরে গ্রহণ করেছে,” বলেন তিনি।
চার দিনের রিমান্ড
সবুজবাগ থেকে আটককৃতরা হলেন নিজাম উদ্দিন (২১), রায়হান ভূইয়া (২০), হানিফ উদ্দিন সুমন (১৯), শেখ ইফতেখারুল ইসলাম ওরফে আরিফ (২৫) ও মুফতি মুসলিম উদ্দিন ওরফে মুসলিম (২৭)।
এদের মধ্যে নিজাম চট্টগ্রামের একটি মাদ্রাসায় ও হানিফ সেখানকার একটি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে কাজ করতেন। রায়হান মালয়েশিয়া থেকে কিছুদিন আগে দেশে আসেন। এ ছাড়া ইফতেখারুল ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভেটেরিনারি মেডিসিনে পড়াশোনা শেষ করেছেন এবং মুসলিম ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে একটি মাদ্রাসায় কর্মরত ছিলেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।
তাঁদের কাছে তিনটি ব্যাগ, চারটি স্মার্ট ফোন এবং তিনটি চাপাতি পাওয়া গেছে।
গ্রেপ্তার পাঁচ জঙ্গিকে সোমবার বিকেলে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে (সিএমএম) হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানায় সিটিটিসি। আবেদনের শুনানি শেষে চারদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন বিচারক শহিদুল ইসলাম।
এর আগে আটকদের বিরুদ্ধে সিটিটিসি সবুজবাগ থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দায়ের করে বলে বেনারকে জানান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহবুব আলম।
“সিটিটিসিই মামলাটি তদন্ত করবে,” জানান ওসি।
অনলাইন দাওয়াতে জঙ্গি
সিটিটিসি কর্মকর্তা ইলিয়াছ জানান, গ্রেপ্তারকৃতরা আনসার আল ইসলামের দাওয়াতি শাখার প্রধান নাজমুল ওরফে উসমান গনি ওরফে আবু আইয়ুব আল আনসারীর দাওয়াতে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই পাঁচ জন সংগঠনে যোগদান করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মেসেঞ্জার চ্যাট গ্রুপ ও অন্যান্য অনলাইন মাধ্যমে তাঁরা এই দাওয়াত পান।
নাজমুল জঙ্গিবাদ বিরোধী চলচ্চিত্র নির্মাণ করায় নির্মাতা খিজির হায়াত খানকে হত্যা প্রচেষ্টার পরিকল্পনায় নেতৃত্ব দেন। তিনি কুয়েতে থাকাকালীন “এসো কাফেলা বদ্ধ হই” নামের একটি টেলিগ্রাম গ্রুপের মাধ্যমে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছিলেন। সংশ্লিষ্ট দুই জঙ্গি গ্রেপ্তার হওয়ায় তাঁদের সে পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
পরবর্তীতে নাজমুল দেশে ফিরে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড সংঘটনের কাজ করছেন বলে জানতে পেরেছে পুলিশ। দুবাই থেকে দেশে ফিরেছেন তাঁর সহযোগী আবু কায়সার ওরফে রনি।
“মধ্যপ্রাচ্য ফেরত এই দুই জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে,” জানান ইলিয়াছ শরীফ।
এর আগে গত ৩১ জানুয়ারি ঢাকার কল্যাণপুর থেকে আনসার আল ইসলামের চার কর্মীকে গ্রেফতার করে র্যাব। এছাড়া ২৭ জানুয়ারি যাত্রাবাড়ী থেকে সংগঠনটির এক নেতা মোহাম্মদ ওমর ফারুক ওরফে আফসার ফরহাদকে (৩০) গ্রেপ্তার করে সিটিটিসি।
জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম এর পুরোনো নাম আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি)। বাংলাদেশে মুক্তমনা ব্লগার হত্যাসহ বিভিন্ন জঙ্গিবাদী কার্যক্রমে সম্পৃক্ততার দায়ে ২০১৫ সালে এবিটিকে নিষিদ্ধ করে সরকার। এবিটি নিষিদ্ধ হওযার পর সংগঠনটি আনসার আল ইসলাম নামে তৎপরতা শুরু করে। ২০১৭ সালের মার্চে আনসার আল ইসলামকেও বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হয়।