মহাসড়কে পরপর দুটি জঙ্গি হামলায় উদ্বেগ
2017.03.07
ঢাকা

কুমিল্লার একটি চেকপোস্টে নিয়মিত বাস তল্লাশির সময় পুলিশের ওপর হামলা হয়েছে। এ ঘটনায় সন্দেহভাজন দুই জঙ্গিকে আটক করেছে পুলিশ। এরা হচ্ছে জসিম উদ্দিন (২৪) ও মো. হাসান (২২)।
এর ঠিক আগের দিনই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হরকাতুল জিহাদের নেতা মুফতি হান্নানকে বহনকারী পুলিশের প্রিজন ভ্যান লক্ষ্য করে ককটেল হামলা করে দুর্বৃত্তরা। এ সময় মোস্তফা নামে একজন সন্দেহভাজন জঙ্গিকে আটক করা হয়।
বেশ কিছুদিন থেমে থাকার পরে দেশে আবারও পরপর দুটি জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটল। দুটি ঘটনার একটি ঘটেছে ঢাকা-ময়মনসিংহ ও অন্যটি ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কে। উভয় ঘটনা উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
২০০৪ সালে সিলেটে হজরত শাহজালালের মাজারের সামনে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলার ঘটনায় মুফতি হান্নানের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। এ রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করেছেন মুফতি হান্নান। শিগগিরই সে আবেদনের শুনানি হওয়ার কথা। আপিল বিভাগে এই আবেদন খারিজ হলে জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নানের ফাঁসি কার্যকর করতে আর বাধা থাকবে না।
এমন অবস্থায় নিজেদের নেতাকে মুক্ত করতে মরিয়া হয়েই নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা কৌশলগতভাবে বিচ্ছিন্ন হামলা চালাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মাহফুজুল হক মারজান বেনারকে বলেন, “সাম্প্রতিক পুলিশি অভিযানে দেশের জঙ্গি সংগঠনগুলোর সক্ষমতা অনেকাংশে কমে এসেছে। তারপরেও জঙ্গিরা নিজেদের নেতাকে ছাড়িয়ে নিয়ে নতুন করে জিহাদে নামার স্বপ্ন থেকেই এ ধরনের আক্রমণ চালাতে পারে।”
একই কায়দায় হামলা
মহাসড়ক পুলিশের দাউদকান্দির ইলিয়টগঞ্জ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) মো. মনিরুল ইসলাম জানান, গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে মহাসড়কের চান্দিনার কুটুম্বপুর এলাকা দিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী শ্যামলী পরিবহনের (ঢাকা মেট্টো-ব-১৪-৪৬৬১) যাত্রীবাহী একটি বাস দ্রুত গতিতে যাচ্ছিল। এ সময় মহাসড়ক পুলিশের সদস্যরা গতি নির্ণয় ও তল্লাশি চালানোর জন্য মহাসড়কের দক্ষিণ পাশে বাসটি থামায়।
এক পর্যায়ে পুলিশের সার্জেন্ট গোলাম মোস্তফা তল্লাশি করতে বাসে উঠতে গেলে দুই জঙ্গি জসিম ও হাসান দুইটি স্কুল ব্যাগ নিয়ে বাস থেকে নেমে দৌড় দেয়। তখন পুলিশও তাঁদের পিছু নেয়। একপর্যায়ে জঙ্গিরা পুলিশকে লক্ষ্য করে প্রথমে একটি এবং পরে আরও পাঁচটি বোমা নিক্ষেপ করে। কিন্তু বোমাগুলো বিস্ফোরিত না হওয়ায় কেউ হতাহত হয়নি।
পরে পুলিশ ও এলাকাবাসী সংগঠিত হয়ে জঙ্গিদের ধাওয়া করে। এ সময় জঙ্গিরা মহাসড়কের উত্তর পাশে ধানিজমির মধ্য দিয়ে দেবীদ্বার উপজেলার খাদ ঘর মসজিদের সামনে যায়। তখন পুলিশ ২৪ রাউন্ড শটগানের গুলি ছোঁড়ে। এ সময় জসিম উদ্দিনের শরীরে গুলি লাগে। আর হাসানকে এলাকার লোকজন ধরে ফেলেন। এ সময় একটি ছুরিও উদ্ধার করা হয়।
পরে তাঁদের উদ্ধার করে চান্দিনা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে তাঁদের কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতালের কারারক্ষী ওয়ার্ডে তাঁদের চিকিৎসা চলছে। আটককৃতদের পরনে ছিল কালো টি-শার্ট ও মোবাইল প্যান্ট।
তাদের মধ্যে হাসানের বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার শান্তিরহাট গ্রামে। সে ওই গ্রামের প্রয়াত মোহাম্মদ হোসাইনের ছেলে। তবে জসিমের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
এ প্রসঙ্গে ডিআইজি আতিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, নিষিদ্ধ কোনো গোষ্ঠী নির্দিষ্ট কাজের জন্য ওই বোমা বহন করছিল। এরা যে জঙ্গি তাতে সন্দেহ নেই। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
ইলিয়টগঞ্জ মহাসড়ক ফাঁড়ির এসআই মো. মনিরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, দুইটি স্কুল ব্যাগে বোমাগুলো ছিল। ছয়টি বোমার মধ্যে চারটি বোমা পাওয়া গেছে। আর দুইটি বোমা পানিতে পড়ে যায়।
মুফতি হান্নানকে বহনকারী গাড়িতে হামলা
এই ঘটনার আগের দিন গত সোমবার ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নানকে বহনকারী পুলিশের একটি প্রিজন ভ্যান লক্ষ্য করে ককটেল ছোঁড়ার সময় এক যুবককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এ প্রসঙ্গে টঙ্গী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ফিরোজ তালুকদার বেনারকে বলেন, “কলেজ গেট এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় এক যুবক প্রিজন ভ্যানটিতে ককটেল ছুঁড়ে মারলে কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ তাকে আটক করে। মোস্তফা নামের ওই যুবকের কাছ থেকে এক ব্যাগভর্তি ককটেল উদ্ধার করা হয়েছে।”
প্রিজন ভ্যানে মুফতি হান্নানসহ ১৯জন আসামি ছিলেন। আদালতে হাজিরা শেষে তাঁদেরকে কারাগারে নেওয়া হচ্ছিল বলে পুলিশ জানায়।
জনগণকে সম্পৃক্ত করে নিরাপত্তা বলয় করতে হবে
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাম্প্রতিক অভিযানে দুর্বল হয়ে পড়া দেশের জঙ্গি সংগঠনগুলো আবারও শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করছে বলে আশঙ্কা করছেন অপরাধ বিজ্ঞানীরা। আর তাদেরকে রুখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সক্রিয় থাকার পাশাপাশি জনগণের মাঝেও সচেতনতা বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছেন তাঁরা।
এ প্রসঙ্গে জঙ্গিবাদ বিশ্লেষক ও আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক নূর খান বেনারকে বলেন, “জঙ্গিরা কৌশলগত কারণে বিভিন্ন সময় ক্ষণিকের বিরতি দেয়। তারপর তারা আবারও একই ধরনের কার্যক্রম নিয়ে ফিরে আসে।”
তাঁর মতে, “জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে গড়তে জনগণকে সম্পৃক্ত করে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করতে হবে। এ ছাড়া কেন জঙ্গিবাদের দিকে আমাদের সন্তানরা ঝুঁকে পড়ছে, সেই জায়গাটা চিহ্নিত করাও জরুরি।”