জঙ্গি দমনে সরাসরি যোগাযোগে সম্মত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পুলিশ
2017.03.14
ঢাকা

জঙ্গিবাদ দমনে ‘ওয়ান টু ওয়ান’ যোগাযোগের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার পুলিশ প্রধান ও শীর্ষ কর্মকর্তারা। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকায় চিফস অব পুলিশ কনফারেন্সের শেষ দিনে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছান তাঁরা।
বাংলাদেশ পুলিশ ও পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোলের আয়োজনে গত ১২ মার্চ তিন দিনব্যাপী ওই সম্মেলন শুরু হয়।
১৪টি দেশের পুলিশ প্রধান ও প্রতিনিধিরা ছাড়াও ফেসবুক, ইন্টারপোল গ্লোবাল কমপ্লেক্স ফর ইনোভেশন (আইজিসিআই), যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই), আসিয়ানাপোল, ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ট্রেনিং অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রামসহ (আইসিআইটিএপি) বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ওই সম্মেলনে অংশ নেন।
সম্মেলন শেষ পুলিশের মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন। তিনি বলেন, “জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় ইন্টারপোলের সহযোগিতায় সব কটি দেশ একটি প্লাটফরম থেকে কাজ করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে।”
“জঙ্গিদের ব্যাপারে তথ্য বিনিময়, গ্রেপ্তার ও হস্তান্তরে এখন থেকে দেশগুলোর পুলিশ একে অন্যের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করবে। এতে করে দ্রুততার সঙ্গে জঙ্গিবাদ দমন করা সম্ভব হবে,” শহীদুল হক বলেন।
এ ছাড়া সন্ত্রাসবাদ এবং আন্তর্দেশীয় অপরাধ দমনে দেশগুলোর মধ্যে তথ্য প্রযুক্তি নেটওয়ার্ক স্থাপন, ফরেনসিক ল্যাবরেটরি এবং ট্রেনিং ইনস্টিটিউটগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর ব্যাপারেও একমত হয়েছে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো।
তবে সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনের অধিবেশনে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর পলিটিক্যাল ভায়োলেন্স অ্যান্ড টেররিজম রিসার্চের (আইসিপিভিটিআর) পরিচালক রোহান গুণারত্নের বক্তব্য নিয়ে যে বিতর্কের সূত্রপাত সেটি অব্যাহত ছিল গতকাল পর্যন্ত।
রোববার রোহান গুণারত্নে ‘ডির্যাডিকালাইজেশন অব মিলিট্যান্টস: অ্যান্ড অ্যাপ্রোচ ফর ডিজএনগেজমেন্ট অ্যান্ড রিইন্ট্রিগেশন ইনটু সোসাইটি’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। শুরুতেই তিনি বলেন, “হলি আর্টিজানে হামলাকারীদের পরিচয় সম্পর্কে বাংলাদেশের রাজনৈতিকরা মিথ্যা বলেছেন। হামলাকারীরা দেশীয় জঙ্গি নয়। তারা আইএস, নব্য জেএমবি নয়।”
তাঁর মতে, “সমস্যার মূলে যেতে হবে। সমস্যাকে স্বীকার করে নিতে হবে। উটের মতো বালুতে মুখ গুঁজে থাকার কোনো যৌক্তিকতা নেই। হলি আর্টিজান ও এর আগে পরে ইতালীয়, জাপানি নাগরিক ছাড়াও যে হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছে সেগুলো ঘটিয়েছে আইএস।
যা নিয়ে বিতর্ক
২০১৪ সাল থেকে ২০১৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী কমপক্ষে ১০ জনকে আইএসের সঙ্গে সম্পৃক্ততার দায়ে গ্রেপ্তার করে। তবে সেপ্টেম্বরে ইতালীয় নাগরিক তাবেলা সিজার হত্যাকাণ্ডের পর আগের অবস্থান থেকে সরে এসে পুলিশ বলতে শুরু করে, বাংলাদেশে আইএস বা আল কায়েদার কোনো উপস্থিতি নেই।
এই দাবি অব্যাহত থাকে ১ জুলাই হলি আর্টিজানে হামলার পরও। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ প্রত্যেকেই আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর উপস্থিতির কথা অস্বীকার করেন।
পুলিশ প্রধানদের সম্মেলনে নতুন করে এই বিতর্ককে উসকে দেন আইসিপিভিটিআর’র পরিচালক রোহান গুণারত্নে।
তিনি বলেন, “১ জুলাই রাতে হলি আর্টিজানের হামলা চলার সময় তাঁর প্রতিষ্ঠান বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে। হামলাকারীরা তাদের হত্যার ধরন দিয়ে বুঝিয়ে দেয়, তারা সিরিয়া ও ইরাক ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের সদস্য।”
তাঁর দাবি, “হামলাটি ঘটেছে তিনটি ভাগে। প্রথম ১৫ মিনিটের মধ্যে গুলি ও জবাই করে রেস্তোরাঁয় আসা ব্যক্তিদের খুন করা হয়। দ্বিতীয় পর্বে তারা আইএসের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং যা আমরা সিঙ্গাপুরে বসে প্রত্যক্ষ করি এবং তৃতীয় পর্বে তারা একটি মানবঢাল তৈরি করে এবং নিজেরা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়।”
রোহান আরও বলেন, “এ কথা সত্য জেএমবি থেকে আইএসের উত্থান। তবে জেএমবি আর নিজেদের জেএমবি বলছে না।”
স্থানীয় কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে এ প্রতিবেদন প্রকাশের পরদিন পুলিশের মহাপরিদর্শক শহীদুল হক সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “এ পর্যন্ত যতগুলো জঙ্গি হামলা হয়েছে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা আসামি গ্রেপ্তার করেছি। অনেকে পুলিশি অভিযানে নিহত হয়েছেন। গ্রেপ্তার থাকা জঙ্গিরা বা নিহতদের স্বজনেরা কেউ বলেননি, তারা আইএসের সদস্য। রোহান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তিনি তাঁর মতো করে বলেছেন। তাঁর কথার কোনো সত্যতা আমরা পাইনি।”
তবে, দেশীয় জঙ্গিদের সঙ্গে ভার্চ্যুয়াল জগতে বিদেশি জঙ্গিদের যোগাযোগ থাকতে পারে বলে জানান আইজিপি।
গতকাল মঙ্গলবার পুলিশ প্রধানদের সম্মেলনের শেষ দিনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, “দেশে আজকে পর্যন্ত কোনো আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর উপস্থিতির খবর নেই। তবে, বাংলাদেশ প্রভাবমুক্ত থাকতে চায় বলে অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে চায়।”
“বাংলাদেশের জঙ্গিরা দেশজ,” বলেন তিনি।
তবে এখনই বাংলাদেশকে আত্মতুষ্টিতে না ভোগার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকেরা। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস এর সহ–উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বেনারকে বলেন, “জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ ভালো করেছে। কর্তৃপক্ষ বলছে দেশে আইএস বা আল কায়েদার মতো জঙ্গিগোষ্ঠীর উপস্থিতি নেই। তবে আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই। এ যুগে যোগাযোগ স্থাপন সবচেয়ে সহজ কাজ।”
সম্মেলনে এক উপস্থাপনায় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, “কৌশলগত কারণে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ জঙ্গিদের হামলার লক্ষ্যবস্তু অমুসলিম জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশের দুই প্রতিবেশীই অমুসলিম জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত।”
সম্মেলন থেকে যা পেল বাংলাদেশ
সম্মেলনে বাংলাদেশের পুলিশ নয়টি দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেছে। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন গুরুত্বপূর্ণ দুটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ইন্টারপোলের মহাসচিব জার্গেন স্টক ও ফেসবুকের ট্রাস্ট ও সেফটি বিভাগের ব্যবস্থাপক বিক্রম লেঙ্গের সঙ্গে।
ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলতে পাসপোর্ট বা জাতীয় পরিচয়পত্র নিতে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের প্রতি অনুরোধও জানিয়েছে পুলিশ। নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হলে ফেসবুক সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
বৈঠক শেষে পুলিশের মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক জানান, বঙ্গবন্ধুর খুনি ডালিম চৌধুরী এখন স্পেনে আছেন জানা গেলেও তাঁর অবস্থান নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বাংলাদেশের পুলিশ ইন্টারপোলের সহযোগিতা কামনা করেছে।
এ ছাড়া বাংলাদেশ পুলিশ দণ্ডিত আসামিদের ধরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা চাইলে, সেটিও দেওয়ার ব্যাপারে আলাপ আলোচনা করেছে।
“আমাদের অনুরোধে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ার্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করেও পরে তা প্রত্যাহার করে নেয়। আমরা এর যৌক্তিকতা সম্পর্কে জানতে চেয়েছি। জারগেন স্টক বিষয়টি দেখবেন বলে জানিয়েছেন,” শহীদুল হক বলেন।
ফেসবুকের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে আইজিপি বলেন, “ধর্মীয় উসকানিমূলক বার্তা প্রচার ও নারী নির্যাতনকে উসকে দেয় এমন কিছু আসলে পুলিশকে জানাতে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে পুলিশ। বাংলাদেশ ফেসবুকের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করতে চেয়েছে। তবে ফেসবুক নীতিমালায় কোনো দেশের সঙ্গে চুক্তি সাক্ষরের সুযোগ নেই। ফেসবুক বাংলাদেশ পুলিশে একজন ফোকাল পয়েন্ট নিয়োগের কথা বলেছে এবং সেই ফোকাল পয়েন্টের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার ব্যাপারে একমত হয়েছে।
এর বাইরে বাংলাদেশ ভিয়েতনাম ও মিয়ানমারের সঙ্গে মাদক পাচার, চীনের সঙ্গে প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সাইবার নিরাপত্তা ইস্যুতে সমঝোতা স্মারক সাক্ষর করার ব্যাপারে একমত হয়েছে। এ ব্যাপারে ইন্টারপোল সহযোগিতা করতে রাজি হয়েছে।