চট্টগ্রামে দুটি জঙ্গি আস্তানার সন্ধান, একটি ঘিরে রাখা হয় রাতভর
2017.03.15
ঢাকা

মাত্র সাতদিনের ব্যবধানে চট্টগ্রামে দুটি জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এই প্রথম একজন বাড়ির মালিকের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জঙ্গি আস্তানার খোঁজ পাওয়া গেলো।
বাড়িওয়ালার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বুধবার বেলা ৩টার পরপরেই সীতাকুণ্ড পৌরসভার আমিরাবাদ এলাকায় সাধন কুটির নামে একটি বাড়ির নিচতলায় পুলিশের অভিযান শুরু হয়। ওই বাড়ি থেকে পুলিশ আত্মঘাতী দলের এক নারী সদস্যসহ দুই জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছে, যারা স্বামী–স্ত্রী।
মো. জসিম ও আর্জিনা নামে ওই দম্পতির সঙ্গে তাদের দুই মাস বয়সী ছেলে সন্তানও ছিল। পুলিশ বলছে, গ্রেপ্তার হওয়া দম্পতি নব্য জেএমবির (জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ) সদস্য।
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের অতিরিক্ত সুপার (উত্তর) মসিউদ্দোল্লাহ রেজা টেলিফোনে বেনারকে জানান, “আমিরাবাদে জঙ্গি দম্পতির বাসা থেকে অস্ত্র, বিস্ফোরক এবং আত্মঘাতি হামলার জন্য বোমার তৈরি বেল্ট (সুইসাইড ভেস্ট) পাওয়া গেছে। গ্রেপ্তারকৃতদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এক কিলোমিটার দূরে প্রেমতলা ওয়ার্ডের চৌধুরী পাড়ার ছায়ানীড় নামের আরেকটি দোতলা বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশ।”
এ অভিযান প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বুধবার রাত পৌনে নয়টার দিকে বেনারকে বলেন, “সীতাকুণ্ডের একটি বাড়ি থেকে আমরা এখন পর্যন্ত এক দম্পতিকে গ্রেপ্তার করেছি। পুলিশ সেখানে আরেকটি বাড়িতে অভিযান চালাচ্ছে।”
এদিকে বাংলাদেশ সময় রাত একটা পর্যন্ত চৌধুরী পাড়ার ছায়ানীড় নামে ওই বাড়িটি ঘিরে রেখেছিল পুলিশ ও র্যাব ছাড়াও গোয়েন্দা পুলিশের সর্বাধুনিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দল স্পেশাল উইপন্স অ্যান্ড ট্যাক্টিস—সোয়াটের সদস্যরা। ওই বাড়িতে অভিযান শুরু করতে গেলে পুলিশের দিকে জঙ্গিদের ছোঁড়া বোমার স্প্রিন্টারে সীতাকুণ্ড থানার ওসি (তদন্ত) মোজাম্মেল হক আহত হয়েছেন।
জঙ্গিরা তিনটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করা ছাড়াও বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়েছে পুলিশকে লক্ষ্য করে। পুলিশও থেমে থেমে ফাঁকা গুলি ছুড়ছে। এতে ঘনবসতিপূর্ণ ওই এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। উল্লেখ্য, দোতলা ওই ভবনে আরও কয়েকটি পরিবার রয়েছে।
চট্টগ্রাম সোয়াট টিমের সদস্য লিয়াকত আলী বেনারকে বলেন, অভিযানের প্রস্তুতি চলছে। ওই বাড়ির আশেপাশে আরও বাড়ি থাকায় অভিযান শুরুর আগে প্রাণহাণি ও ক্ষয়ক্ষতির কথা ভাবতে হচ্ছে। তা ছাড়া ওই ভবনের বাসিন্দাদের নিরাপদে সরানোর চেষ্টা করা হবে।
গতকাল রাতেই সোয়াটের একটি দল ঢাকা থেকে রওনা হয়। রাত পৌনে একটায় দলটি ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। সোয়াট সদস্যরা বেশ কিছু সময় ওই বাড়ির কিছুটা দূরে তিনটি গাড়িতে বসেছিলেন।
স্থানীয় সাংবাদিক এস এম আলমগীর রাত একটায় টেলিফোনে বেনারকে জানান, সোয়াট সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছালে সাংবাদিকেরা তাঁদের দিকে এগিয়ে যান। কিন্তু তাঁদের কেউ কোনও কথা বলতে চাননি। সোয়াটের একজন কর্মকর্তা জানান, অপারেশনের পর কথা বলবেন।
ওই সাংবাদিক আরও জানান, অভিযান কখন শুরু হবে, তা বলতে চাননি সোয়াট কর্মকর্তারা। তাঁরা বলেছেন, পরিবেশ–পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে অভিযান শুরু করা হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একজন কর্মকর্তা বেনারকে বলেন, সমন্বিত অভিযান হবে। এ জন্য সময় নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। তবে শেষ রাতে বা ভোরের দিকে জঙ্গি দমনে অভিযান চালানো হতে পারে বলে আভাস দেন তিনি। তার আগে গ্যাস, পানি ও বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হতে পারে।
কাউন্সিলর মুরাদ জানান, জঙ্গিদের ছোড়া গ্রেনেড বিস্ফোরণের সময় পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। শব্দ শুনে গ্রেনেডগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী মনে হয়েছে।
এর আগে গত ৮ মার্চ কুমিল্লায় দুই জঙ্গিকে আটক করার পর তাদের একজনকে নিয়ে ওই রাতেই মিরসরাইয়ের একটি বাড়িতে অভিযান চালায়। সেখান থেকে হাতবোমা, বোমা তৈরির যন্ত্রপাতি, চাপাতি, বিয়ারিংয়ের বল এবং আরবিতে লেখা একটি কালো পতাকা উদ্ধার করে পুলিশ।
তার আগের দিন কুমিল্লার চান্দিনায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে নিয়মিত বাস তল্লাশির সময় পুলিশকে হামলা করে দুই জঙ্গি। স্থানীয়দের সহযোগিতায় তাদেরকে আটক করা হয়। মিরসরাইয়ের বাড়িটি ছিল তাদের আস্তানা।
যেভাবে জঙ্গি আস্তানার সন্ধান মেলে
বাড়িওয়ালা সুভাষ দাসের তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ বুধবার বেলা তিনটার দিকে সীতাকুণ্ড পৌর এলাকার নামার বাজার ওয়ার্ডের আমিরাবাদে তার বাসায় অভিযান চালায়।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রেজাউর রহমান সাংবাদিকদের বলেছেন, “নিজের ভাড়াটিয়াকে জঙ্গি সন্দেহ হওয়ার পর বুধবার বেলা আড়াইটার দিকে সুভাষ দাস পুলিশকে বিষয়টি জানান। পুলিশ তৎক্ষণাৎ বাড়িটি ঘিরে ফেলে।
“পুলিশ প্রথমে ওই দম্পতিকে বেরিয়ে আসতে বলে। কিন্তু তারা বেরিয়ে না আসলে পুলিশ জোর করে ঘরে ঢুকে পড়ে,” জানান রেজাউর রহমান।
রেজাউর বলেন, “আর্জিনা একটি আত্মঘাতী বেল্ট পরে ছিল। তার হাত ওই বেল্টের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। বাড়ির মালিক ও তাঁর স্ত্রী তখন আর্জিনাকে শক্ত করে ধরে ফেলেন যাতে সে বিস্ফোরণ ঘটাতে না পারে।”
বাড়িওয়ালা সুভাষ দাস সাংবাদিকদের বলেন, গত ৪ মার্চ জসিম তার স্ত্রী আর্জিনা, শিশু সন্তান ও দুই শ্যালককে নিয়ে বাড়িটি ভাড়া নেয়। জসিম তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রের একটি কপিও দেয়। বাড়ি ভাড়া নেওয়ার পর থেকে ওই পরিবার তাদের ঘরের জানালা সব সময় বন্ধ রাখত।
এক সময় বিষয়টি তাঁর মনে সন্দেহ জাগায়। এরপর তিনি জাতীয় পরিচয়পত্রের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে যান। নির্বাচন কমিশন পরিচয়পত্রটি ভুয়া বলে জানিয়ে দেয়।
সুভাষ দাস বলেন, মঙ্গলবার তিনি তাঁদের বাসায় ঢুকে পড়েন। কক্ষের মধ্যে প্রচুর তার ও সার্কিট ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখেন। জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা সার্কিট বানানোর কাজ করে বলে জানায়।
উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে বাড়ি ভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে বাড়িওয়ালাদের সতর্ক করা হচ্ছে। এ কারণেই সুভাষ দত্ত সচেতন হয়েছেন বলে তিনি সাংবাদিকদের জানান।