সীতাকুণ্ডে পুলিশি অভিযানে চার জঙ্গি ও এক শিশু নিহত

প্রাপ্তি রহমান
2017.03.16
ঢাকা
সোয়াট সদস্যদের প্রস্তুতি। সোয়াট সদস্যদের প্রস্তুতি। মার্চ ১৬, ২০১৭।
স্টার মেইল

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার ‘ছায়া নীড়’ নামের বাড়িটিতে পুলিশের ১৮ ঘণ্টাব্যাপী শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান শেষ হয়েছে চার জঙ্গি নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে। এ ঘটনায় একটি শিশুও নিহত হয়েছে। ওই বাড়িতে এ নিয়ে এক নারী ও তিন পুরুষসহ মোট পাঁচজনের লাশ পাওয়া গেল।

অভিযানে পুলিশ এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের চারজন আহত হন। পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. শফিকুল ইসলাম বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে অভিযানের প্রাথমিক সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

এ ছাড়া পৃথক ঘটনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলায় পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে একজনের মৃত্যু হয়েছে। নিহত তাজুল ইসলাম মাহমুদ ওরফে মামা হুজুর (৪৬) হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা। পুলিশ জানায়, সে হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের সদস্য।

ছায়ানীড়ে অভিযান

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান চলে ‘ছায়ানীড়’ নামের একটি বাড়ি ঘিরে। দুই তলা ওই বাড়ির একতলা ও দোতলার মাঝামাঝি স্থানের সিঁড়িতে এক নারী ও আনুমানিক আড়াই/তিন বছর বয়সী একটি শিশুর লাশ পাওয়া যায়।

চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান বেনারকে বলেন, সকালে অভিযানের সময় জঙ্গিরা যখন আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটায়, তখনই শিশুটির মৃত্যু হয় বলে তাদের ধারণা।

“নিহত চার জঙ্গির মধ্যে একজন নারী। এদের একজন পুলিশের গুলিতে ও বাকি তিনজন আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণে নিহত হয়েছেন। নিহত চার জঙ্গির মধ্যে দুজনের হাত, পা ও মুখমণ্ডল বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। তাদের চেহারা বোঝার উপায় নেই। বাকি দুজনের চেহারা বোঝা যাচ্ছে,” ডিআইজি শফিকুল ইসলাম বলেন।

আহত চারজনের তিনজন পুলিশ সদস্য ও অন্যজন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তা। আহতদের প্রথমে সীতাকুণ্ড উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

ছায়া নীড়ের বাকি ২০ বাসিন্দাকে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে। তাঁদের সবাই এখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন।

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সীতাকুণ্ডে ছায়ানীড় নামের বাসাটি থেকে অস্ত্র, গোলাবারুদ উদ্ধারের কাজ চলছিল। পুলিশ বলছে জঙ্গিরা দোতলায় দুটি ঘরে ছিল। সেখানে প্রচুর বিস্ফোরক আছে, এ ছাড়া ছাদ থেকে বিপুল পরিমাণ বোমার মজুত উদ্ধার করা হয়েছে।

প্রাথমিকভাবে জঙ্গিদের সবাই নব্য জেএমবির সদস্য বলে পুলিশের ধারণা জানিয়ে চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. শফিকুল ইসলাম ব্রিফিংয়ে বলেন, “ধারণা করা হচ্ছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে যেসব বিদেশি যুক্ত আছেন তাঁদের ওপর হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল জঙ্গিরা।”

যেভাবে অভিযান

সীতাকুণ্ড পৌর এলাকার নামার বাজার ওয়ার্ডের আমিরাবাদ এলাকায় এক বাড়িওয়ালার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বুধবার বিকেল ৩টার পর পুলিশ সাধন কুটির নামের একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে দুই জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে। অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ জসিম ও আর্জিনা দম্পতিকে গ্রেপ্তারের পরপরই পুলিশকে ছুটতে হয় কয়েকশ মিটার দূরে প্রেমতলা নামক জায়গায় দ্বিতীয় অভিযানের জন্য।

বিকেল ৪টার দিকে পুলিশ সদস্যরা প্রেমতলার ছায়া নীড়ে পৌঁছানোর সঙ্গেসঙ্গেই দোতলা থেকে ছোড়া গ্রেনেডে আহত হন সীতাকুণ্ড থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোজাম্মেল হক।

‘ছায়া নীড়’ নামে এই বাড়িতে জঙ্গিদের অবস্থান ছিল। মার্চ ১৫, ২০১৭।
‘ছায়া নীড়’ নামে এই বাড়িতে জঙ্গিদের অবস্থান ছিল। মার্চ ১৫, ২০১৭।
[স্টার মেইল]
প্রথম দলটি বাধার মুখে পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যে সীতাকুণ্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইফতেখার হোসেন ঘটনাস্থলে হাজির হন। তাঁর দলটি বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে। এর মধ্যেই জঙ্গিরা পুলিশকে লক্ষ্য করে দফায় দফায় গ্রেনেড ছুড়তে থাকে। মাঝে মধ্যে গোলাগুলি হয়।

সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে চট্টগ্রাম পুলিশের বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দল সোয়াট বাড়ির চারদিকে অবস্থান নেয়। প্রায় একই সময়ে ঢাকা থেকে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট চট্টগ্রামের দিকে রওনা হয়। তাদের সঙ্গে সোয়াটের আরও কিছু সদস্য, বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল, পুলিশ সদর দপ্তরের এলআইসি দলের সদস্যরাও চট্টগ্রামের দিকে রওনা দেয়।

রাত ৯টার দিকে বাড়ির সামনে অবস্থান নেয় সাঁজোয়া যান।

চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের অতিরিক্ত সুপার (উত্তর) মসি উদ দৌলা রেজা বেনারকে বলেন, ঢাকা থেকে পুলিশের এই দল যাওয়ার পর ভবনটিতে চূড়ান্ত অভিযানের বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়।

“আমরা রাতেই ওই ভবনে আটকা পড়া পরিবারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করি। তাঁরা বাইরে আসতে চাইলেও আমরা নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁদের দরজা বন্ধ করে বাসায় থাকার অনুরোধ করি,” মসি উদ দৌলা রেজা বলেন।

চূড়ান্ত অভিযানের আগে দফায় দফায় মাইকে জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের অনুরোধ জানায় পুলিশ। সেই সঙ্গে ছায়া নীড়ের অন্যান্য বাড়িতে অবস্থানরত বাসিন্দাদের বের করে আনার কৌশল নিয়ে আলোচনা হয়।

আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিয়ে পাল্টা হামলা জঙ্গিদের

বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৬টায় পুলিশ মূল অভিযান ‘অপারেশন অ্যাসল্ট সিক্সটিন’ শুরু করে। পুলিশ গুলি ছুড়লে জঙ্গিরা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পাল্টা জবাব দেয়।

এ অবস্থা চলে প্রায় মিনিট দশেক। পুরো এলাকা একটু পরপর কেঁপে ওঠে ও বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়।

যে জায়গাটি পুলিশ ঘেরাও করে রেখেছিল সে জায়গা থেকে সকালে অভিযান শুরুর কিছুক্ষণ পর সোয়াটের দুই সদস্যকে অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়া হয়।

অভিযান শেষে সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি শফিকুল ইসলাম বলেন, “চূড়ান্ত অভিযান শুরুর পর সোয়াট সদস্যরা ছায়া নীড়ের পাশের একটি ভবনের ছাদে ওঠেন। তাঁদের দেখেই দুই জঙ্গি আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিতে দিতে বিস্ফোরক কোমরবন্ধনীতে হাত দেয়। সোয়াট সদস্যরা গুলি ছুড়লে একজন মাটিতে পড়ে যায়। কিন্তু অন্যজন বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম হয়।”

অন্য দুজন জঙ্গি সিঁড়িঘরে ছিল। তারাও আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত বলে ধারণা করা হচ্ছে।

নিহতদের মধ্যে যে নারী কালো বোরকা পরা ছিলেন তার বয়স আনুমানিক ২৭/২৮ বছর।

ছায়া নীড়ের মালিক ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তুলে নিয়ে গেছে।

সতর্ক থাকার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর ইশফাক এলাহী চৌধুরী বেনারকে বলেন, বাংলাদেশ জঙ্গিবাদের দ্বিমুখী সমস্যায় পড়েছে। সতর্ক থাকা খুব প্রয়োজন।

“প্রথমত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালাচ্ছে কিন্তু জঙ্গিবাদ নির্মূল হয়নি। দ্বিতীয়ত ইরাকের মসুল ও সিরিয়ার রাকায় ভীষণভাবে আইএস পরাজিত হতে থাকায়, দেশীয় জঙ্গি ও বিদেশি পাসপোর্টধারী বাংলাদেশি জঙ্গিরা দেশে ফেরার চেষ্টা করছে। চোখ-কান খোলা রাখা এ অবস্থায় খুবই জরুরি,” ইশফাক বলেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।