নিউজিল্যান্ডে মসজিদে হামলায় নিহত বাংলাদেশির সংখ্যা বেড়ে পাঁচ
2019.03.18
ঢাকা

নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে দুই মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় নিহত বাংলাদেশির সংখ্যা বেড়ে হয়েছে পাঁচজন। এ তথ্য নিশ্চিত করেছে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশন ও বাংলাদেশ সরকার।
এদিকে ওই হামলার ঘটনায় নিউজিল্যান্ড ভ্রমণে বাংলাদেশিদের জন্য সতর্কতা জারি করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “যদি কোনো বাংলাদেশি এখন নিউজিল্যান্ড ভ্রমণ করতে চান আমরা তাঁদেরকে বলব আপনারা সেটি বিশেষ বিবেচনায় সতর্কতার সহিত সিদ্ধান্ত নিবেন।”
ক্যানবেরা থেকে বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. সুফিউর রহমান সোমবার বেনারকে বলেন, “নিউজিল্যান্ড কর্তৃপক্ষ থেকে তথ্য পেতে কিছুটা দেরি হওয়ায় নিহত বাংলাদেশির সংখ্যা নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি তৈরি হয়। তবে সব শেষ খবর হলো, ওই সন্ত্রাসী হামলায় পাঁচজন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন।”
পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেন, “এতদিনে তথ্য দেওয়া শুরু করেছে দেশটির সরকার। এজন্যই নিহত আহতদের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি ছিল।”
ড. মোমেন জানান, নিউজিল্যান্ডে নিহতরা হলেন- সিলেটের ফরিদ আহমেদের স্ত্রী গোলাপগঞ্জের হুসনে আরা আহমেদ (৪২), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ড. আবদুস সামাদ (৬৬), চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলার মোজাম্মেল হক (৩০) ও নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার ওমর ফারুক (৩৫) এবং নরসিংদীর জাকারিয়া ভুঁইয়া (৩৬)।
ওই বন্দুক হামলায় আহত তিনজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। এরা হলেন কিশোরগঞ্জের সাজেদা আক্তার লিপি, গাজীপুরের মুতাসিম বিল্লাহ ও শেখ হাসান রুবেল। এদের মধ্যে লিপির অবস্থা বেশ সংকটজনক বলে জানান সুফিউর রহমান। তাঁর এখনো একটি অপারেশন বাকি। বাকিরা আশঙ্কামুক্ত।
এছাড়া শাওন নামে একজন নিখোঁজ রয়েছেন বলেও জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
এদিকে সোমবার থেকে মরদেহ হস্তান্তরের কথা থাকলেও নিউজিল্যান্ড কর্তৃপক্ষ তা শুরু করতে পারেনি বলে বেনারকে জানান নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশের অনারারি কনসাল শফিকুর রহমান ভুঁইয়া। যিনি এখন ক্রাইস্টচার্চে অবস্থান করছেন।
তিনি বলেন, “নিউজিল্যান্ড কর্তৃপক্ষ সোমবার থেকে লাশ হস্তান্তরের কথা বলেছিল। তবে আজ তারা জানিয়েছে, সকল কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় লাশ হস্তান্তর শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না।”
“এক বৈঠকে দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে হতাহতদের আনুষ্ঠানিক তালিকা প্রকাশ করতেই বুধবার পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। তারপরেই লাশ হস্তান্তর শুরু হবে,” বলেন তিনি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন সাংবাদিকদের জানান, নিহতদের মরদেহ ফিরিয়ে আনতে নিউজিল্যান্ড সরকার তাঁদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে যাবে। দেশটির সরকার নিহত বাংলাদেশিদের প্রত্যেকের অন্তত একজনকে সে দেশে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে।
লাশ আনতে নিহতদের আগ্রহী স্বজনদেরকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করতেও বলা হয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “অস্ট্রেলিয়ায় আমাদের হাই কমিশনের দুইজন কর্মকর্তা এবং নিউজিল্যান্ডে অনারারি কনসাল এই তিনজন এখন ক্রাইস্টচার্চে আছেন। নিউজিল্যান্ড সরকারের সাথে আমরা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করছি। কোনো গ্যাপ নেই।”
হাইকমিশনার সুফিউর বলেন, “নিউজিল্যান্ড কর্তৃপক্ষ লাশ হস্তান্তর শুরু করলেই নিহত বাংলাদেশিদের লাশ ফেরত পাঠানো হবে।”
“তবে নিহত পাঁচ বাংলাদেশির মধ্যে দুই জনের লাশ নিউজিল্যান্ডেই দাফন করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে তাঁদের স্বজনরা,” হাইকমিশনার সুফিউর বলেন।
প্রসঙ্গত, গত শুক্রবার দুপুরে জুমার নামাজের সময় ক্রাইস্টচার্চের আল নূর ও লিনউড মসজিদে হামলা চালায় একজন বন্দুকধারী। এতে নিহত হন ৫০ জন। হামলাকারীর নাম ব্রেনটন ট্যারেন্ট। ২৮ বছর বয়সী এই শ্বেতাঙ্গ অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। তাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে তোলা হয়।
ওই হামলার ঘটনার সময় নিউজিল্যান্ড সফরে থাকা বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের কয়েকজন সদস্য আল নূর মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে যাচ্ছিলেন। অল্পের জন্য তারা প্রাণে বেঁচে যান। ঘটনার পর সফর শেষ না করেই দেশে ফেরে বাংলাদেশ দল।
দেশে ফিরে তাঁরা বলেন, “সে এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। সেই দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে আমাদের অনেকদিন সময় লাগবে।”
শেখ হাসিনাকে ট্রুডোর ফোন
সোমবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেলিফোন করে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিউজিল্যান্ডে মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়েছেন বলে গণমাধ্যমকে জানান প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম।
তিনি জানান, ওই ঘটনায় বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের সদস্যদের কোনো রকম ক্ষতি না হওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করেন জাস্টিন ট্রুডো। এসময় দুই প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব সম্প্রদায়কে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানান।
এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তায়িপ এরদোয়ান, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানসহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এবং জাতিসংঘের পক্ষ থেকেও ওই হামলার নিন্দা জানিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর প্রতি সমবেদনা জানানো হয়েছে।
এদিকে নিউজিল্যান্ডে দুইটি মসজিদে সন্ত্রাসী হামলায় হতাহতের ঘটনায় বাংলাদেশের মন্ত্রীসভা সোমবার শোক ও নিন্দা জানিয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম।
‘শোকে ঐক্যবদ্ধ’ নিউজিল্যান্ড
ক্রাইস্টচার্চের হামলার ঘটনায় নিউজিল্যান্ডের মুসলিমরা স্তম্ভিত ও মর্মাহত হলেও তাঁরা শান্ত রয়েছেন বলে জানিয়েছেন মুসলিম নেতারা।
বার্তাসংস্থা রয়টার্স এক প্রতিবেদনে জানায়, নিউজিল্যান্ডের ফেডারেল ইসলামিক অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মোস্তফা ফারুক শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “আমরা এমন এক দেশে বাস করি যেখানে আমাদের জন্য রয়েছে ভালোবাসা ও প্রশ্রয়। পৃথিবীর সবচে সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ দেশগুলোর একটি।”
যারা ঘৃণার বিস্তার করে তারা ‘মারাত্মকভাবে ব্যর্থ’ মন্তব্য করে ফারুক বলেন, “কারণ তারা যা করেছে, যদি আদৌ কিছু করে থাকে, তবে তা হলো আমাদের নিজেদের দেশের জন্য ভালোবাসা ও অনুভূতি বাড়িয়ে দেওয়া, আমরা মানুষের বিপুল ভালোবাসার স্রোত দেখতে পাচ্ছি, যাকে আমরা নিউজিল্যান্ডের ভাষায় ‘আরোহা’ বলে চিহ্নিত করি।”
এদিকে ক্রাইস্টচার্চের আক্রমণের স্থানগুলোতে নিহতদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে দেশটির হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছে বলে জানায় রয়টার্স।
প্রসঙ্গত, ঘটনার পরদিন শনিবার নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন মুসলিম নারীদের মতো হিজাব পরে ক্রাইস্টচার্চে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর সাথে দেখা করে তাঁদের সমবেদনা জানান।
এ সময় সারা দেশ ‘শোকে ঐক্যবদ্ধ’ বলে সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করেন জাসিন্ডা।