নতুন নেতৃত্বে সংগঠিত হচ্ছে জঙ্গিরা, মাঠে সক্রিয় একাধিক গ্রুপ
2017.03.20
ঢাকা

গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার পর জঙ্গি আস্তানাগুলোয় এক ডজন ‘সফল’ পুলিশি অভিযান চলে। তামীম চৌধুরীসহ প্রায় অর্ধশতাধিক জঙ্গির মৃত্যুর পর দেশজুড়ে জঙ্গি হামলার প্রকোপ একরকম শূন্যের কোঠায় নেমে আসে।
কিন্তু সাম্প্রতিক পরপর চারটি ঘটনায় নতুন করে জনমনে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের কর্মকর্তারা এখন বলছেন, নব্য জেএমবি নতুন করে সংগঠিত হয়েছে বলে তাঁরা ধারণা করছেন। তাদের বোমাগুলো আগের চেয়েও বেশি শক্তিশালী, অর্থ ও অস্ত্র দুয়েরই জোগান বেড়েছে।
মাইনুল ইসলাম ওরফে মুসা কিছুদিন দলের নেতৃত্বে থাকলেও, নতুন কেউ নব্য জেএমবির হাল ধরেছে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে আরও বেশ কিছু আস্তানাও গড়ে উঠেছে।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে দুটি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান শেষ হওয়ার পরদিন ২৭ মার্চ র্যাবের নির্মাণাধীন সদর দপ্তরের সামনে আত্মঘাতী হামলা এবং একদিন পর তল্লাশি চৌকিতে হামলার চেষ্টা হয়।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক সাখাওয়াত হোসেন বেনার নিউজকে বলেন, “গত কয়েক দিনের ঘটনাগুলো বলছে যে জঙ্গিরা আবারও শক্তি নিয়ে সংঘটিত হচ্ছে।”
পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক মো. সাখাওয়াত হোসেন জানান, সীতাকুণ্ডের জঙ্গি আস্তানা থেকে যে ধরনের সুইসাইডাল ভেস্ট উদ্ধার করা হয়েছে, আশকোনায় র্যাব সদর দপ্তরের সামনে আত্মঘাতী বোমারু একই ধরনের ভেস্ট পরিহিত অবস্থায় ছিলেন। সীতাকুণ্ড থেকে গ্রেপ্তার জঙ্গিরা যেসব তথ্য দিচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে ঢাকা ও চট্টগ্রামে নাশকতামূলক কিছু করার পরিকল্পনা ছিল তাদের।
“আগে একটি ঘটনার পর আমরা জঙ্গিদের কিছুদিন অপেক্ষা করতে দেখেছি। এবার তা হয়নি। বোঝাই যাচ্ছে মাঠে এখন তাদের একাধিক গ্রুপ সক্রিয়,” বেনারকে বলেন মো. সাখাওয়াত হোসেন।
তিনি বলেন, পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের হেফাজতে থাকা আহমেদ আজওয়াজ ইমতিয়াজ তালুকদার জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, ধরা পড়ার আগে সে বোমার দুটি চালান ঢাকায় পাঠিয়েছিল।
গত ৮ মার্চ আজওয়াজ পুলিশের দিকে বোমা নিক্ষেপের চেষ্টা করার সময় কুমিল্লার চান্দিনায় গ্রেপ্তার হয়।
আরও হামলার আশঙ্কা?
পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা এবং হলি আর্টিজান হামলার অন্যতম তদন্তকারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নব্য জেএমবিকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে তামিম চৌধুরীর মতো ‘ক্যারিশমাটিক’ কোনো নেতা কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে।
“মাঈনুল ইসলাম ওরফে মুসা সম্পর্কে আমাদের কাছে যা তথ্য আছে, তাতে আমরা মোটামুটি নিশ্চিত তার পক্ষে একাধারে দল গোছানো, নতুন কর্মী নিয়োগ, অর্থ, অস্ত্র ও বোমার জোগান বাড়ানোর সক্ষমতা নেই,” ওই কর্মকর্তা বলেন।
পুলিশের ভাষ্যমতে, মাঈনুল ইসলাম ওরফে মুসা চট্টগ্রাম অঞ্চলে নব্য জেএমবির সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে বলে ধারণা করছে পুলিশ। সামরিক প্রশিক্ষকের দায়িত্বে হাদিছুর রহমান ওরফে সাগর, চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রধান মোশারফ হোসেন, তাদের ঘনিষ্ঠ সহচর ফরহাদ ও মনির এবং বোমা তৈরির কারিগর নসরুল্লাহ।
চট্টগ্রামে জঙ্গিদের অবস্থান বেশ শক্ত হয়ে থাকতে পারে বলে পুলিশের আশঙ্কা। এর বাইরে ঢাকা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, খুলনা, ঝিনাইদহ ও সিলেটের কোথাও কোথাও জঙ্গি আস্তানা থাকতে পারে বলে ধারণা করছে পুলিশ।
হলি আর্টিজানে হামলার পরও ঘর ছেড়েছে তরুণেরা
সীতাকুণ্ডের ছায়া নীড়ে পুলিশি অভিযানের সময় নিহত চার জঙ্গির দুজন আহমেদ রাফিদ আল হাসান ও আয়াদ বলে ধারণা করছে পুলিশ। তারা পরস্পরের খালাতো ভাই। গত বছরের ৯ আগস্ট চিরকুট লিখে একসঙ্গে বাড়ি ছাড়ে তারা। এরপর থেকে নিখোঁজ ছিল। ঢাকার মিরপুরের পূর্ব মণিপুরের বাসিন্দা ছিল এই দুই তরুণ।
আহমেদ রাফিদ আল হাসানের মা নীলুফার ইয়াসমিন বেনারকে বলেন, ছেলে বাড়ি ছাড়ার পর তাঁর সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ করেনি।
“দুই ভাই নিখোঁজ হওয়ার পরপরই আমরা মিরপুর থানায় মিসিং জিডি করি। কিছুদিন পর জানতে পারি বিষয়টা কাউন্টার টেররজিম দেখছে। তখনই আঁচ করতে পারি আসলে কী হয়েছে। আমরা তো সময় মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানালাম। ছেলেকে তারপরও ওদের খপ্পর থেকে বের করা গেল না,”, নীলুফার বেনারকে বলেন।
পুলিশের সূত্রমতে ৮ মার্চ ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের চান্দিনা থেকে গ্রেপ্তার আহমেদ আজওয়াজ ইমতিয়াজ তালুকদার জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দলের সংখ্যা এখন কমপক্ষে পাঁচ, একেকটিতে সদস্য সংখ্যাও কমপক্ষে পাঁচজন করে। প্রশিক্ষণার্থীদের তালিকায় আরও প্রায় ৫০ জন আছে।
পরিস্থিতি সংকটজনক
পরিস্থিতি আবারও সংকটজনক হয়ে উঠছে বলে মনে করছে পুলিশ। ২৪ ডিসেম্বর প্রথম আশকোনার সূর্য ভিলায় আত্মঘাতী হামলা ঘটায় শাকিরা। একই কায়দায় আত্মঘাতী হামলার ঘটনা ঘটেছে সীতাকুণ্ডে।
কুমিল্লার চান্দিনায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে আজওয়াজ ও মাহমুদ হাসান পুলিশের দিকে যে বোমা ছুড়তে চেয়েছিল সেগুলো ছিল আগের বোমাগুলোর তুলনায় দুই থেকে তিনগুণ বেশি শক্তিশালী।
কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. ছানোয়ার হোসেন বলেন, “ওই দুজন পুলিশের দিকে যে ছয়টি হাতে তৈরি গ্রেনেড ছুড়েছিল, সেগুলো যে কোনো বিবেচনায় অনেক বেশি ক্ষতি করতে সক্ষম।
সীতাকুণ্ডের ছায়া নীড়ের যে বাসাটি জঙ্গিরা ভাড়া নিয়েছিল, সেই বাসার শুধু একটি ঘর থেকে ১৫টি শক্তিশালী বোমা এবং বোমা তৈরির সরঞ্জামসহ ছয়টি ড্রাম উদ্ধার করা হয়। ছয়টি ড্রামের পাঁচটিতে ৪০ লিটার করে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ও একটিতে অ্যাসিড রয়েছে বলে জানায় বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের সদস্যরা।
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস এর সহউপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, জঙ্গিবাদের সমস্যা খুব দ্রুত মোকাবিলা করা যাবে বলে মনে হয় না। বরং অন্যান্য দেশের প্রভাব দেখা যেতে পারে প্রকটভাবে। সেরকমটা দেখাও যাচ্ছে।
“মরক্কো থেকে পাকিস্তান, বাংলাদেশকে ঘিরে আরাকান, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের একটি অংশ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাই, ফিলিপাইনের দক্ষিণাঞ্চল ঘিরে জঙ্গি তৎপরতা আরও বাড়তে পারে,” কলিমুল্লাহ বেনারকে বলেন।