মুফতি হান্নানের ফাঁসি কার্যকরে আইনি সব প্রক্রিয়া শেষ
2017.03.20
ঢাকা

সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন নাকচ হয়ে যাওয়ায় হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানের ফাঁসি কার্যকরের বিষয়ে দিনক্ষণ গণনা শুরু হয়েছে। গত রবিবার সুপ্রিম কোর্ট মুফতি হান্নানসহ তিন জঙ্গির মৃত্যুদণ্ডের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ করে দেওয়ার পর প্রাণভিক্ষা এখন তার শেষ অবলম্বন।
এক যুগের বেশি আগে বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা মামলায় এই রায় দিয়েছিল সর্বোচ্চ আদালত।
এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বেনারকে বলেন, “এখন থেকে ৭দিন পর এবং ২১ দিনের মধ্যে যে কোনো দিন ফাঁসি কার্যকর হবে। তবে এর মধ্যে দণ্ডিতরা প্রাণভিক্ষা চাইলে রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। প্রাণভিক্ষা না চাইলে দণ্ড কার্যকরে কোনো বাধা নেই।”
২০০৪ সালে সিলেটে হজরত শাহজালাল এর মাজারে রাষ্ট্রদূত আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলার ঘটনায় এক পুলিশ কর্মকর্তাসহ তিনজন নিহত হয়েছিলেন। আহত হয়েছিলেন ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতসহ ৪০ জন।
এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আব্দুল হান্নানসহ তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড দেয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল। পরে হাইকোর্ট এবং আপিল বিভাগেও তা বহাল থাকে।
মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত অপর দুই আসামি হলেন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের (হুজি-বি) সদস্য শরীফ শাহেদুল আলম ওরফে বিপুল এবং দেলোয়ার হোসেন ওরফে রিপন।
২০০১ সালে রাজধানীর রমনা বটমূলে ছায়ানটের ঐতিহ্যবাহী বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে বহু মানুষ হতাহত করার ঘটনায় জজ আদালত থেকে ফাঁসির দণ্ড পেয়েছেন মুফতি হান্নান।
মামলাটি হাইকোর্টে নিষ্পত্তির আগেই আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলার ঘটনায় সর্বোচ্চ আদালতে তার মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত হয়েছে। হান্নানের বিরুদ্ধে থাকা আরও ১৩টি মামলার বিচার চলছে। দুটির অধিকতর তদন্ত চলছে।
তার বিরুদ্ধে ঢাকায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ সাতটি, সিলেটে অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যাসহ পাঁচটি এবং নারায়ণগঞ্জ ও খুলনায় তিন মামলা চলমান আছে।
১৩ জঙ্গি হামলায় ১০১ জন মানুষ হত্যার হোতা
সাত বছরে ১৩টি হামলা চালিয়ে ১০১ জন মানুষকে হত্যার মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন এই ভয়াবহ জঙ্গি নেতা। এসব নাশকতার ঘটনায় অন্তত ৬০৯ জন আহত হয়েছেন। চিরতরে পঙ্গু হয়েছেন বহু মানুষ।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের (হুজি-বি) জঙ্গিরা ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ থেকে ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত সাত বছর সময়ে অন্তত ১৩টি নাশকতামূলক ঘটনা ঘটায়। এসবের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন মুফতি হান্নান।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্যও হান্নানের নির্দেশে তিন দফা চেষ্টা হয়েছে। ২০০৬ সালের ১৯ নভেম্বর এবং ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর দুই দফায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে মুফতি হান্নান এসব হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের বিস্তারিত বিবরণ দেন।
এর আগে ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর রাজধানীর বাড্ডার বাসা থেকে গ্রেপ্তার হন মুফতি হান্নান।
১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে হুজি-বি–র বোমা হামলায় ১০ জন নিহত ও দেড় শ জন আহত হন। একই বছরের ৮ অক্টোবর খুলনা শহরের আহমদিয়া মসজিদে বোমা হামলায় নিহত হন আটজন।
২০০০ সালের জুলাইয়ে কোটালীপাড়ায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভাস্থলের কাছাকাছি ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রেখে হত্যার চেষ্টা চালায়।
২০০১ সালে ঢাকায় সিপিবির সমাবেশে, রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানসহ ছয়টি বোমা হামলার ঘটনা ঘটায় জঙ্গিরা। শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালায় ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে তাঁর সমাবেশে। এতে আওয়ামী লীগের ২২ জন নেতা-কর্মী নিহত হন। আহত হন শেখ হাসিনাসহ শতাধিক ব্যক্তি।
এ ছাড়া হান্নানের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জের এক সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। ওই হামলায় আওয়ামী লীগের নেতা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াসহ পাঁচজন নিহত হন।
হান্নানের নির্দেশেই প্রিজন ভ্যানে হামলা
এদিকে ফাঁসির দণ্ড নিয়ে কারাবন্দী অবস্থাতেই মুফতি হান্নান সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে নিয়মিত মোবাইলে কথা বলতেন। আর এ সময়ই সালেহ আহমেদ নামে এক অনুসারীকে মোবাইলে কারাগার থেকে আদালতে আনা-নেওয়ার সময় প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে তাঁকে ছিনিয়ে নিতে নির্দেশ দেন হান্নান।
গত ১ মার্চ গ্রেপ্তার হওয়া ওই হুজি সদস্য আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এ কথা স্বীকার করেন বলে তদন্ত সূত্রে জানা গেছে।
গাজীপুরের টঙ্গীতে মুফতি হান্নানকে ছিনিয়ে নিতে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালানোর পাঁচ দিন আগে হুজি সদস্যদের একটি গোপন বৈঠকের সময় রাজধানীর কমলাপুর থেকে গ্রেপ্তার হন সালেহ আহমেদ। আরও চারজন পালিয়ে যায়। পরে ১৪ মার্চ ঢাকার একটি আদালতে জবানবন্দি দেন সালেহ।
জবানবন্দিতে সালেহ আহমেদ বলেছেন, হান্নানের নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি কাজ করতেন। যে ফোনে মুফতি হান্নানের সঙ্গে যোগাযোগ হতো, সেই মোবাইল ফোনটি সালেহ আহমেদের বাসা থেকে জব্দ করে পুলিশ। তাতে মুফতি হান্নানের পাঠানো রেকর্ড করা বক্তব্য পাওয়ার কথা জানিয়েছে পুলিশ।
তবে “হান্নানের আদর্শ অনুসারীরা যত দিন থাকবে, তত দিন দেশ থেকে বাংলাদেশ থেকে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ নির্মূল হবে না। এর জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সচেষ্ট থাকতে হবে। এ কাজে সরকারের পাশাপাশি জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে।”
এক প্রতিক্রিয়ায় বেনারকে জানান একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতা শাহরিয়ার কবির।
প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন জেসমিন পাপড়ি