জঙ্গি সংশ্লিষ্টতায় বহুজাতিক কোম্পানির কর্মকর্তাসহ গ্রেপ্তার পাঁচ

প্রাপ্তি রহমান
2017.03.21
ঢাকা
গ্রেপ্তারকৃতদের সংবাদ সম্মেলনে হাজির করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতদের সংবাদ সম্মেলনে হাজির করা হয়। মার্চ ২১, ২০১৭।
সৌজন্যে: পুলিশ সদর দপ্তর

রাজধানীর বাড্ডা এলাকা থেকে র‌্যাব–১০ এর একটি দল পাঁচ সন্দেহভাজন জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছে। র‌্যাব বলছে, জঙ্গিদের এই দলটি সরকারি স্থাপনায় হামলার পরিকল্পনা করছিল।

মঙ্গলবার র‌্যাব সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানানো হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- অলিউজ্জামান ওরফে অলি (২৮), আনোয়ারুল আলম (২৯), সালেহ আহাম্মেদ শীষ (২২), আবুল কাশেম (২৭) ও মো. মোহন ওরফে মহসিন (২০)। এদের মধ্যে একজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গি আসামি মুফতি হান্নানের আত্মীয়।

২০ মার্চ রাত সাড়ে ৮টা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত বাড্ডা এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রথমে অলিউজ্জামান ও আনোয়ারুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাঁদের দেওয়া তথ্যে বাকি তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আনোয়ার লতিফ খান দাবি করেন, প্রায় সোয়া এক বছর ধরে এই পাঁচজনসহ ১০-১২জন ‘জঙ্গি’ একসঙ্গে কাজ করছে। এরা প্রত্যেকে আলাদা আলাদা কাজের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল।

“এদের অধিকাংশই কাফরুল ও মিরপুর এলাকার বাসিন্দা। সেলটির নিয়ন্ত্রক অলিউজ্জামান ওরফে অলি। সেলটি সম্প্রতি সরকারি স্থাপনায় নাশকতার পরিকল্পনা করেছে। ওই হামলা চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয় মনির এবং সালমান ওরফে আব্দুল্লাহকে,” বলেন আনোয়ার লতিফ।

মনির এবং সালমান ওরফে আবদুল্লাহ নামে দুজন পালিয়ে গেছে বলেও জানান তিনি।

গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে বিস্ফোরক, বোমা তৈরির সরঞ্জামাদি, জঙ্গিবাদী বই, খেলনা পিস্তল ও বন্দুক, নগদ ৩ লাখ ১৪ হাজার টাকা এবং অন্যান্য সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ স্বীকার করে নিয়েছে বলে দাবি করেছে র‌্যাব।

গ্রেপ্তারকৃতদের মাঝে দুজন প্রকৌশলী!

র‍্যাব জানিয়েছে, অলিউজ্জামান ওরফে অলি একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী। সে বুয়েট থেকে ২০১২ সালে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে। বুয়েটে পড়ার সময়ই সে ধর্মকর্মে ঝুঁকে পড়ে বিভিন্ন ধর্মীয় বই-পুস্তক, লিফলেট ও অনলাইনে বিভিন্ন সাইটের মাধ্যমে উগ্রবাদী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়। ২০১৫ সালের শেষের দিকে অলি জেএমবি’র ‘সারোয়ার-তামীম’ গ্রুপে যুক্ত হয়। কাফরুল এলাকার একটি জঙ্গি সেল পরিচালনা ছিল অলির দায়িত্ব।

অলিউজ্জামান ঠিক কী কাজ করত জানতে চাইলে র‌্যাবের আইন ও গণসংযোগ শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ বেনারকে খান বলেন, “প্রায় সোয়া এক বছর ধরে অলিউজ্জামান ইন্টারনেট ও টেলিগ্রাম আইডি ব্যবহারের ওপর দীক্ষা দেয়। তার নেতৃত্বে তাদের দলের সদস্যরা ফেসবুকে ইসলাম অবমাননাকারী স্ট্যাটাস ভাইরাল আকারে পোস্ট করে সহানুভূতি ও সমর্থন আদায়ের জন্য প্রচার চালাত।”

গ্রেপ্তারকৃত অপর সদস্য আনোয়ারুল আলম ছিল অলিউজ্জামানের সহপাঠী। বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র আনোয়ারুল একটি কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করত। অলির মাধ্যমে সে “সারোয়ার-তামীম” জঙ্গি গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত হয়ে বোমা তৈরির দায়িত্ব পায়।

এই দলের আরেক সদস্য আবুল কাশেম (২৭) ২০০৪ সালে মিরপুর ১৩ নম্বরের দারুল উলুম মাদ্রাসার ছাত্র ছিল। সেখান থেকে কামরাঙ্গীরচর ফরিদাবাদ জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম মাদ্রাসায় চলে যায়। ২০১৪ সালে দাওরা হাদিস পাশ করে টিউশনি করত। ২০১৬ সালের শুরুর দিকে তার সঙ্গে অলিউজ্জামানের পরিচয় হয়। ইন্টারনেট থেকে আরবিতে লেখা উগ্রবাদী বিষয় বাংলায় ভাষান্তর করে প্রচার করত সে।

গ্রেপ্তারকৃত আসামি সালেহ আহাম্মেদ শীষ (২২) মিরপুর সেনপাড়া বায়তুল মামুর মাদ্রাসা থেকে ২০১২ সালে দাখিল পাশ করে মিরপুর বাঙলা কলেজে ডিগ্রি (পাস) কোর্সে ভর্তি হয়। তাকেও উদ্বুদ্ধ করে অলিউজ্জামান। বছর খানেক আগে সে চট্টগ্রামে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নেয়।

র‌্যাব জানায়, সালেহ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গি আসামি মুফতি হান্নানের আত্মীয় বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে।

মোহন ওরফে মহসিন ২০১৪ সাল হতে বিভিন্ন পরিবহনের হেলপার হিসেবে কাজ করেছে। তাকে উদ্বুদ্ধ করে আবুল কাশেম। জিজ্ঞাসাবাদে সে জানায়, কাশেম তাকে উগ্রবাদী ভিডিও দেখাত এবং জিহাদের প্রস্তুতি নিতে বলত।

এই দলটির সঙ্গে গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলাকারীদের যোগাযোগ ছিল কি না জানতে চাইলে র‍্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আনোয়ার লতিফ খান কোনো জবাব দেননি। তিনি বেনারকে বলেন “তদন্ত খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। বিস্তারিত কিছু বলা যাচ্ছে না।”

র‍্যাবের অভিযান নিয়ে প্রশ্ন

এদিকে আশকোনায় র‍্যাবের নির্মাণাধীন সদর দপ্তরের সামনে আত্মঘাতী বোমা হামলার পর র‍্যাব হেফাজতে হানিফ মৃধা নামে এক আসামির মৃত্যু নিয়ে জঙ্গিবাদ বিরোধী অভিযান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

১৭ ঘণ্টার ব্যবধানে খিলগাঁওয়ের চেক পোস্টে হামলার অভিযোগে গুলি করে হত্যা করা হয় আরেক সন্দেহভাজন জঙ্গিকে। ওই ঘটনাটি নিয়েও র‍্যাবের কাছ থেকে দু’রকম বক্তব্য পাওয়া যায়।

হানিফ মৃধার বোন রোজিনা বেগম বেনারকে জানান, আশকোনায় আত্মঘাতী হামলার দিনে আটক করার কথা জানালেও র‍্যাব পরিচয়ে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকা থেকে তার ভাইকে তুলে নিয়ে যায়।

“তুলে নিয়ে যাওয়ার প্রায় দু’ সপ্তাহ পরেও আমার ভাইয়ের ঢাকার বাসায় র‍্যাবের গাড়িতে করে প্রায় ১৫ জন এসেছিলেন। আমরা তার আগেই ৪ মার্চ সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় জিডিও করি,” বলেন তিনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

মানবাধিকার কর্মীদের উদ্বেগ

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “এসব ঘটনা মানুষের মধ্যে র‍্যাবের কার্যক্রম নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি করেছে।”

“হামিদ মৃধার পরিবার যে অভিযোগ করেছে তা অত্যন্ত গুরুতর। এই ঘটনা খতিয়ে দেখা দরকার এবং দায়িত্বটা দেওয়া উচিত বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটদের হাতে,” নূর খান বলেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।