হলি আর্টিজানে নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সম্মাননা দিচ্ছে সরকার
2018.03.21
ঢাকা

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচে বড় সন্ত্রাসী হামলা হলি আর্টিজান বেকারি হত্যাকাণ্ডে নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সম্মাননা দিতে যাচ্ছে সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এই তথ্য জানিয়ে বলেছেন, নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে ১৫ হাজার ইউরো বা সমপরিমাণ অর্থ দেওয়া হবে।
“আগামী ২৫ মার্চ রাজারবাগ পুলিশলাইন অডিটোরিয়ামে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান নিহতদের উপস্থিত পরিবার সদস্যদের কাছে ওই চেক হস্তান্তর করবেন,” বেনারকে বলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য কর্মকর্তা শরীফ অপু।
অনুষ্ঠানের আয়োজক কমিটির সভাপতি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. সামসুর রহমান বেনারকে বলেন, মোট ২০জন নিহত ব্যক্তির মধ্যে বাংলাদেশের তিনজন ও ভারতের একজন নাগরিকের পরিবারের সদস্যরা ২৫ মার্চের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন বলে গতকাল পর্যন্ত নিশ্চিত করেছেন।
“ওই অনুষ্ঠানে হলি আর্টিজান হামলায় নিহত বাংলাদেশের তিনজন ও ভারতের একজনের পরিবারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা ক্রেস্ট ও চেক তুলে দেবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী,” বলেন শামসুর রহমান।
প্রসঙ্গত, নিহত তিন বাংলাদেশির মধ্যে একজন বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ নাগরিক ছিলেন।
সামসুর রহমান জানান, ভিকটিমদের মধ্যে একজন জাপানি নাগরিকের পরিবার আর্থিক সাহায্য নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, হামলায় নিহত নয় ইতালীয় ও ছয় জাপানি নাগরিকের পরিবারের কাছে আর্থিক চেক ও ক্রেস্ট সেদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া হবে।
শামসুর রহমান বলেন, “আমরা চেকগুলো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পৌঁছে দিয়েছি।”
কেন এই আয়োজন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বেনারকে বলেন, “আসলে কোনো মানুষের আর্থিক ক্ষতিপূরণ হয় না। তাই আমরা এটাকে আর্থিক সম্মাননা বলছি। এই উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা সবাইকে এই বার্তা দিতে চাই যে বাংলাদেশ হলি আর্টিজান হামলাকে ভুলে যায়নি।”
“সরকার সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বিরোধী কার্যক্রম চালিয়ে যাবে,” তিনি বলেন।
শামসুর রহমান বলেন, যারা আর্থিক চেক নিচ্ছেন তাঁরা কেউই ব্যক্তিগতভাবে টাকাটি ব্যবহার করবেন না। যেমন নিহত বাংলাদেশের নাগরিকদের পরিবারের সদস্যরা নিজেরা একটি ফাউন্ডেশন করেছেন। টাকাটা তাঁরা ফাউন্ডেশনের কাজে ব্যয় করবেন।
এদিকে ওই হামলার ঘটনায় নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তার পরিবারকে প্রধানমন্ত্রী ও পুলিশের পক্ষ থেকে আলাদাভাবে আগেই অনুদান দেয়া হয়েছে।
তবে একই ঘটনায় জঙ্গি সন্দেহে নিহত হবার কারণে হলি আর্টিজান বেকারির দুই কর্মচারী; সাইফুল ইসলাম চৌকিদার ও জাকির হোসেন শাওনের পরিবার কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ বা অনুদান পাচ্ছে না।
২০১৬ সালের পয়লা জুলাই সন্ধ্যায় গুলশান কূটনৈতিক পাড়ায় অবস্থিত হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় ইসলামিক স্টেটের আদর্শে বিশ্বাসী নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন নিও জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (নিও-জেএমবি) পাঁচ জঙ্গি হামলা চালিয়ে ১৭ বিদেশিসহ তিন বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করে।
হামলায় নয় ইতালীয়, সাত জাপানি, একজন ভারতীয় ও তিন বাংলাদেশি প্রাণ হারান। জঙ্গিদের আক্রমণে দু’জন পুলিশ কর্মকর্তাও নিহত হন। আরও নিহত হন হলি আর্টিজানের দুজন কর্মচারী। পাঁচ জঙ্গি বাদে সব মিলিয়ে হলি আর্টিজান হামলায় ২৪ জন নিহত হন।
নিহত বাংলাদেশের নাগরিকেরা হলেন, ফায়াজ আইয়াজ হোসেন, ইশরাত জাহান আখন্দ ও অবিন্তা কবির। ভারতের নাগরিক হলেন তারিশি জেইন।
পরের দিন সকালে কমান্ডো অভিযানে ওই পাঁচ জঙ্গি নিহত হয়।
আইএসের মিডিয়াতে পাঁচ আক্রমণকারীকে তাদের ‘সৈনিক’ বলে দাবি করে হামলার দায় স্বীকার করে সিরিয়া-ইরাক ভিত্তিক সুন্নি জঙ্গি গোষ্ঠী।
কমান্ডো অভিযান শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগেই আইএস মিডিয়াতে পাঁচ জঙ্গির ছবিসহ তাদের আরবি নাম দিয়ে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। তারা জানায়, হলি আর্টিজান বেকারিতে ২০জনকে হত্যা করা হয়েছে।
আক্রমণকারীদের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তাদের সহপাঠীরা তাদের শনাক্ত করে। তারা হলো; নিবরাস ইসলাম, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, মীর সামেহ মোবাশ্বের, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল।
তবে সরকার বরাবর বাংলাদেশের মাটিতে আইএস’র উপস্থিতি অস্বীকার করে আসছে। সরকারের মতে নিও জেএমবি নামক স্থানীয় জঙ্গি সংগঠন এই হামলা চালিয়েছে।
বাংলাদেশি একজন ভিকটিমের অভিভাবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে অনুরোধ করা হয়েছে। তিনি অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন।
“আশার কথা হলো সরকার হলি আর্টিজান হামলার কথা ভুলে যায়নি। আমরা চাই বিশ্বের কোথাও যেন এ ধরনের নৃশংস ঘটনা আর না ঘটে। কোনো মা-বাবার বুক যেন খালি না হয়,” জানান ওই অভিভাবক।
তদন্ত শেষ হয়নি
প্রায় দুই বছর অতিবাহিত হতে চললেও পুলিশ হলি আর্টিজান বেকারি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দিতে পারেনি।
ওই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বেনারকে বলেন, “কবে নাগাদ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবো এটা বলা কঠিন। কারণ এখনো কিছু আসামি বাইরে আছে। আমরা তাদের চিহ্নিত করেছি।”
“মামলাটি খুবই স্পর্শকাতর হওয়ায় তদন্ত ফাইন্ডিংস সম্পর্কে আগাম কিছু বলা যাবে না,” জানান ওই কর্মকর্তা।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম গত বছরের শেষভাগে বলেছিলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে হলি আর্টিজান হামলার প্রতিবেদন জমা দেবেন।
এদিকে নাম নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্তের সাথে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বেনারকে জানান, ওই হামলার সাথে জড়িত সন্দেহে পুলিশ মোট ২২ জনকে চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে বিভিন্ন সময় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ১৩ জন নিহত, ছয় জন আটক ও তিনজন পলাতক রয়েছেন।
তবে ওই হামলার ঘটনায় আটক নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হাসনাত করীম হামলার সাথে জড়িত ছিলেন কি না সে বিষয়ে পুলিশ এখনো নিশ্চিত নয় বলে জানান ওই কর্মকর্তা।