পুরোনো মামলার ‘আইএস’রা নতুন অভিযোগপত্রে ‘দেশজ জঙ্গি’
2017.03.23
ঢাকা

ইরাক ও সিরিয়া ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে গ্রেপ্তার কমপক্ষে নয়জনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ওই জঙ্গি গোষ্ঠীর কোনো যোগাযোগ ছিল না বলে এখন দাবি করছে বাংলাদেশের পুলিশ। এমনকি আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার পরে পুনঃতদন্তে গিয়ে ‘আইএস’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছে।
মামলার নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, মামলা দায়েরের সময় অভিযোগপত্রে পুলিশ উল্লেখ করেছিল, অভিযুক্তরা আইএসের চর ও নিয়োগকর্তা। তাদের উদ্দেশ্য ছিল গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠা। অভিযোগপত্রে পুলিশ অন্যান্য অপরাধের বিবরণ একই রেখে, শুধু আইএস শব্দটি বাদ দিয়ে আসামিরা নব্য জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও জুনুদ আল তাওহিদ বলে উল্লেখ করে।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ শাখার মুখপাত্র মাসুদুর রহমান বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে বিদেশি জঙ্গিগোষ্ঠীর উপস্থিতি নেই। পুলিশ সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে যা পেয়েছে, তা–ই অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেছে।”
২০১৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে আবদুল্লাহ আল তাসনিম, নায়েম আলী, সিকান্দার আলী, মাহমুদ ইবনে বসর, মাসুম বিল্লাহ, ফুয়াদ হাসান এবং আলী আহমদকে গ্রেপ্তার করে। অভিযোগ ছিল তাঁরা আইএসের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করেছেন।
ওই ঘটনার পর থেকে ২০১৫ সালের জুন মাসের শেষভাগ পর্যন্ত কমপক্ষে ১৮ জনকে ওই একই অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। আইএস সম্পৃক্ততার অভিযোগে ২০১৫ সালের ৬ জুন ফিদা মুনতাসির সাকের ও তার কথার সূত্র ধরে ১২ জুন ফাইয়াজ ইসমাম খানকে গ্রেপ্তার করা হয়।
নতুন অভিযোগপত্রে সবাই ‘দেশজ জঙ্গি’
গত ১৩ মার্চ আদালত আবদুল্লাহ আল গালিব, ফিদা মুনতাসির সাকের, আসিফ পাঠান ওরফে রাহাত, ফাইয়াজ ইসমাম খান ও সাব্বির হোসেন ওরফে প্রান্তের বিরুদ্ধে পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্র গ্রহণ করে। আগামী ২ এপ্রিল চার্জ গঠনের শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।
এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে সরকার পক্ষের কৌঁসুলি তাপস পাল বেনারকে বলেন, “অভিযুক্তদের মধ্যে ফিদা মুনতাসির ও ফাইয়াজ ইসমাম আগে হিযবুত তাহরিরের সদস্য ছিল। পরে তারা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমে যোগ দেয়। জুনুদ আল তাওহীদ আর কিলাফাহ নামে নতুন একটি জঙ্গি সংগঠন তৈরি করে। তারা দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করছিল”,
তিনি জানান, আন্তর্জাতিক কোনো জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগের কথা জানা যায়নি। বাকি তিনজনও দেশীয় জঙ্গি।
২০১৫ সালের ৩১ মে আবদুল্লাহ আল গালিবকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে ধারাবাহিকভাবে গ্রেপ্তার হন ফিদা মুনতাসির সাকের ও ফাইয়াজ ইসমাম খান। তিনজনই সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের ছেলে।
থানায় পুলিশের দায়ের করা এজাহারে আবদুল্লাহ আল গালিব সম্পর্কে বলা হয়েছিল, তিনি জুনুদ আল তৌহিদ ওয়াল খালিফার প্রধান এবং বাংলাদেশে আইএসের সদস্য ও নিয়োগকর্তা।
ফিদা মুনতাসির ও ফাইয়াজ ইসমাম সম্পর্কে ক্যান্টনমেন্ট থানায় দায়ের করা মামলার এজাহারে পুলিশ বলেছিল, আসামিরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আইএস এর কর্মী সংগ্রহ ও লোকদের আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ দিত। তাঁরা আইএস এর প্রতিনিধি।
কিন্তু অভিযোগপত্রে বাকি সব তথ্য অবিকৃত রেখে শুধু ‘আইএস’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছে।
“আসামিরা নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য ছিলেন,” বলেন তদন্ত কর্মকর্তা মো. জহির হোসেন।
তিনি জানান, “তদন্তের সময় আইএসর বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।”
পুলিশ ফিদা মুনতাসিরের বন্ধু হিসেবে যাদের নাম নথিবদ্ধ করেছে তাদের অন্তত দুজন আইএসের পক্ষে সহিংসতায় যোগ দিয়ে নিহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। সবশেষ গত বুধবার জানা যায় যে, গত বছরের শেষ দিকে আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিয়াজ মোরশেদ রাজা নিহত হয়েছেন। নিয়াজের বাড়ি চট্টগ্রামের খান্দকিয়ায়। তাঁর বোন জান্নাতুল মাওয়া এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেন।
“২০১৫ সালের শুরুর দিকে নিয়াজ নিখোঁজ হলে ওই সময় থানায় একটি জিডি করা হয়। গত বছরের শেষদিকে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন করে জানানো হয় ইরাকের তিকরিতে আত্মঘাতী বোমা হামলায় আমার ভাই নিহত হয়েছে,” বেনারকে জানান জান্নাতুল মাওয়া।
২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে ডিবি পুলিশ রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, খিলগাঁও ও সূত্রাপুর থানায় সন্ত্রাস বিরোধী আইনে চারটি মামলা করে। এসব মামলার আসামি ছিলেন শাখাওয়াতুল কবির, নজরুল, বাতেন এবং রবিউল। অভিযোগপত্রে পুলিশ জানায়, শাখাওয়াতুল কবির জেএমবির সদস্য ছিল। সে পাকিস্তানে প্রশিক্ষণ নিয়ে আইএসের সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করছে। তাঁর ভায়রা শামীমসহ সাজ্জাত ওরফে কারগিল, সায়েম ও অভি নামের বাংলাদেশি আইএস জঙ্গির সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়।
বিচার শুরুর পর পুলিশ গত ফেব্রুয়ারিতে মামলাটি পুনঃতদন্তের আবেদন জানায়। আদালত সেই আবেদনে সাড়া দিলে সম্প্রতি পুলিশ ওই মামলায় সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে। এতে আগের প্রতিবেদনে সাক্ষীদের ১৬১ ধারার জবানবন্দিতে আইএস শব্দ ছিল তা বাদ দেওয়া হয়েছে।
ওই মামলার সাক্ষী পুলিশের উপপরিদর্শক মশিউর রহমান আগের জবানবন্দিতে বলেছিলেন, আসামি শাখাওয়াতুল আইএসের সমন্বয়ক। অপর আসামি আনোয়ার বাতেন বাংলাদেশে আইএসের আঞ্চলিক সমন্বয়ক।
তবে সম্পূরক অভিযোগপত্রে তিনি আসামিদের বলেছেন জেএমবির সদস্য।
রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে জঙ্গিদের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ অস্বীকার
২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ইতালীয় নাগরিক তাবেলা সিজার হত্যাকাণ্ডের পর থেকে পুলিশ বলতে শুরু করে, বাংলাদেশে আইএস বা আল কায়েদার কোনো উপস্থিতি নেই। ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজানে হামলার পর প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ প্রত্যেকেই দেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর উপস্থিতির কথা অস্বীকার করেন।
গত ১৩ মার্চ চিফস অফ পুলিশ সম্মেলনে পুলিশের মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক তাঁদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেন, “বাংলাদেশের কোনো জঙ্গি ইরাক ও সিরিয়ায় গিয়ে প্রশিক্ষণ নেয়নি। ওই দেশগুলো থেকে অস্ত্র, গোলাবারুদ আনারও কোনো খবর নেই। তবে মতাদর্শগত মিল থেকে থাকতে পারে। ইন্টারনেটেও যোগাযোগ থাকতে পারে।”
তবে ওই সম্মেলনের আগে, গত ২ মার্চ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বেনারকে বলেন, “সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দেশি জঙ্গিদের সঙ্গে বিদেশিদের কোনো যোগাযোগ নেই এমনটাই বলছে পুলিশ। তবে বাস্তবতা আলাদা।”