সিলেটে জঙ্গি আস্তানা ঘেরাও, ঢাকায় বিমানবন্দরের কাছে বোমায় নিহত ১
2017.03.24
ঢাকা

জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে সিলেটের একটি পাঁচতলা ভবন বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত তিনটা থেকে ঘিরে রেখেছে পুলিশ। রাত পৌনে আটটার দিকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে। ডেকে পাঠানো হয়েছে কমান্ডো বাহিনীকে।
দিনভর সিলেটে জঙ্গিবাদ বিরোধী অভিযান চলাকালে রাত আটটার দিকে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে পুলিশ চেকপোস্টের কাছে একটি বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ এলাকার কাছে পরপর দুটি ঘটনা ঘটল।
এদিকে বিমানবন্দরের কাছে ওই আত্মঘাতী বোমা হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট—আইএস। আমাক বার্তা সংস্থার বরাত দিয়ে সাইট ইন্টেলিজেন্স রাতে এ তথ্য জানায়।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা বিমান বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নূরে আজম মিয়াকে উদ্ধৃত করে জানায়, বোমা বিস্ফোরণে অজ্ঞাত এই যুবক ঘটনাস্থলেই মারা যায়। বোমার স্পিন্টারে তার শরীরের বিভিন্ন অংশ ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। নিহত যুবকের বয়স আনুমানিক ২৮ থেকে ৩০ বছর।
তবে ঘটনাস্থলে ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, এটি কোনো হামলার ঘটনা নয়।
“সে বোমা বহন করছিল। পুলিশের ব্যাপক প্রস্তুতি দেখে অতি সতর্ক হতে গিয়ে বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। সে কারণে পুলিশ বা সাধারণ জনগণের মধ্যে হতাহতের ঘটনা ঘটেনি,” আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন।
এদিকে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “বোমা পরিবহনের সময় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।”
গত বৃহস্পতিবার রাত আড়াইটা থেকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পুলিশ সিলেটের আছিয়া ভবন ঘিরে রাখে। চূড়ান্ত অভিযান শুরুর জন্য অপেক্ষা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের উপকমিশনার মহিবুল ইসলাম খান বেনারকে বলেন, সীতাকুণ্ড থেকে গ্রেপ্তার জঙ্গিদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সিলেটে আস্তানার খবর পাওয়া যায়।
ঘটনাস্থলে আছেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার আবদুল মান্নান। বেনারকে তিনি বলেন, ভবনটির অবস্থান শনাক্ত করতে বেশ কয়েক দিন লেগেছে।
“আমাদের কাছে সিলেটসহ বেশ কয়েকটি জেলায় জঙ্গি আস্তানা থাকার খবর ছিল। এরপর থেকেই আমরা নগরীর বিভিন্ন এলাকায় অনুসন্ধান চালাই। বৃহস্পতিবারই শিববাড়ির ওই ভবনের সন্ধান পাওয়া যায়,” আবদুল মান্নান বলেন।
জানা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাছে চান্দিনা থেকে গ্রেপ্তার আহাদ আজওয়াজ ইমতিয়াজ তালুকদার ও মাহমুদ হাসান এবং সীতাকুণ্ডের সাধন কুটির থেকে গ্রেপ্তার দম্পতি জসিম ও আর্জিনার তথ্যের ভিত্তিতে সিলেটের আস্তানাটি চিহ্নিত হয়। সিলেটের পার্শ্ববর্তী উঁচুনিচু পাহাড়ে ঘেরা জেলাগুলোকেও সতর্ক অবস্থানে যেতে বলা হয়।
সুনিশ্চিত তথ্যের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার রাত আড়াইটার দিকে সিলেটের দক্ষিণ সুরমা ইউনিয়নের শিববাড়ি এলাকার আছিয়া ভবনকে ঘিরে ফেলে পুলিশ। পাঁচতলা ভবনের নিচতলায় জঙ্গি আস্তানা বলে গণমাধ্যমকে জানায় পুলিশ। ওই ভবনে ৩০টি ইউনিট রয়েছে।
প্রথমে সিলেট মহানগর পুলিশ ও পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্যরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেও, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হন প্রথমে র্যাব ও পরে স্পেশাল উইপনস অ্যান্ড ট্যাকটিক্স (সোয়াট) ও বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিট। রাত পৌনে আটটার দিকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে সেনাবাহিনী ও কমান্ডো বাহিনী যোগ দেয়।
দিনভর পুলিশ হ্যান্ড মাইকে জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানায়। রাতের দিকে সিলেট মহানগর পুলিশ কমিশনার গোলাম কিবরিয়া সাংবাদিকদের বলেন, তাঁরা জঙ্গিদের আত্মসমর্পণ করানোর চেষ্টা করছেন। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত চূড়ান্ত অভিযান কখন শুরু হবে সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।
পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক (গোপনীয়) মো. মনিরুজ্জামান রাতের দিকে পুলিশ সদর দপ্তরের একটি দল নিয়ে সিলেটের দিকে রওনা হন।
“আমরা সব সময় বলে আসছি, প্রতিটি অভিযানে জঙ্গিদের জীবিত গ্রেপ্তার করা আমাদের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য। সেই সঙ্গে কোথাও যেন সাধারণ মানুষের কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হয় পুলিশ তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে,” মনিরুজ্জামান বেনারকে বলেন।
জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের আহ্বান
সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মো. রোকন উদ্দীন সাংবাদিকদের বলেন, ভোর চারটার দিকে পুলিশকে উদ্দেশ্য করে বাসার ভেতর থেকে হাত বোমা ছুড়ে মারে জঙ্গিরা। পুলিশও থেমে থেমে পাল্টা গুলি ছোড়ে। সকাল আটটার দিকে আবারও পুলিশকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছোড়ে জঙ্গিরা। তারা ‘আল্লাহু আকবর’ বলে স্লোগান দেয়।
ভোর রাতে ভবনের আশপাশের বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়া হয়। পুলিশ ওই ভবনগুলোয় অবস্থান নেয়। আছিয়া ভবনের বাসিন্দাদের দরজা জানালা বন্ধ করে সাবধানে থাকারও পরামর্শ দেয় পুলিশ।
সিলেট মহানগর পুলিশ, পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের সদস্যরা ঘটনাস্থলে অবস্থান নেন।
সকাল ১০টার দিকে চূড়ান্ত অভিযানের জন্য পুলিশের স্পেশাল উইপনস অ্যান্ড ট্যাকটিকস—সোয়াট সিলেটের উদ্দেশে রওনা দেয়।
বেলা একটা থেকে পুলিশ হ্যান্ড মাইকে জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের অনুরোধ জানায়। পুলিশকে বলতে শোনা যায়, ‘মর্জিনা বেগম, আপনি শুনতে পাচ্ছেন? আপনারা বেরিয়ে আসেন। পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। আপনাদের কোনো সমস্যা হবে না।’
বেলা সাড়ে ৩টা পর্যন্ত পুলিশ বিরতি দিয়ে এই অনুরোধ জানাতে থাকে। এ সময় একটি মুঠোফোন নম্বর পুলিশ বারবার মাইকে প্রচার করতে থাকে। ভেতরে থাকা জঙ্গিদের ওই নম্বরে যোগাযোগ করতে বলা হয়। এরপর পুলিশ কয়েক দফা ফাঁকা গুলি ছোড়ে।
নিয়মকানুন মেনে বাড়ি ভাড়া দেওয়া হয়
আছিয়া ভবনের মালিকের নাম উস্তার মিয়া। তিনি আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা করেন।
উস্তার মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে এ বছরের জানুয়ারিতে ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেয় ‘জঙ্গি’রা। তারা তাদের নাম কাওসার আলী ও মর্জিনা বেগম বলে জানায়।
“ভাড়াটিয়া তথ্য ফরমে সব তথ্য আছে। কাওসার আলী বলেছিল সে প্রাণ কোম্পানির অডিট অফিসার। পুলিশকে আমি সব তথ্য সরবরাহ করেছি,” উস্তার মিয়া সাংবাদিকদের বলেন।
ভবনটিতে ২৯টি পরিবার অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। সকালেই ভবনের বিদ্যুৎ সংযোগ ছিন্ন করা হয়।
বিমানবন্দরে নিরাপত্তা বাড়ানো হলো
বোমা বিস্ফোরণের পর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। গত শুক্রবারে আশকোনায় আত্মঘাতী হামলার পরই নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছিল। সেটি আরও জোরদার করা হয়েছে।