সিলেটে জঙ্গি দমন অভিযানে দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ নিহত ছয়
2017.03.25
ঢাকা

সিলেটের শিববাড়ি এলাকার জঙ্গি আস্তানা ‘আতিয়া মহলে’ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান চলাকালে দুই দফা বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ অন্তত ছয়জন নিহত হয়েছেন। আহতের সংখ্যা অন্তত ৪০ জন।
আহত অনেকের অবস্থাই আশঙ্কাজনক। হাসাপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, হতাহতের সংখ্যা বাড়তে পারে। এ ঘটনায় দেশের বিভিন্নস্থানে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত থেকে প্রায় ৩০ ঘণ্টা ঘিরে রাখার পরে শনিবার সকালে বাড়িটিতে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে অভিযান শুরু করে পুলিশের বিশেষ বাহিনী সোয়াট ও পুলিশ। সকাল থেকে একে একে সরিয়ে নেওয়া হয় ওই ভবনে আটকা পড়া বাসিন্দাদের।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ নামের অভিযান নিয়ে শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করছিলেন সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান। ব্রিফিং শেষ হওয়ার কয়েক মিনিট পর সন্ধ্যা সাতটার দিকে ব্রিফিংস্থলের খুব কাছে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে কয়েকজন সাংবাদিকসহ ৩০ জনের বেশি আহত হন।
প্রথম বিস্ফোরণের ঘণ্টাখানেক পরে রাত আটটার দিকে চারদিকে যখন ছোটাছুটি চলছিল তখন আগের ঘটনাস্থলের কাছে পূর্ব পাঠানপাড়া মসজিদ এলাকায় আরও একটি বোমার বিস্ফোরণ হয়। এতে ঘটনাস্থলেই অন্তত চারজন নিহত হন।
ঘটনাস্থলে নিহতদের একজন সিলেট মহানগর পুলিশের পরিদর্শক চৌধুরী মো. আবু ফয়সাল। অপর দুজন হলেন সিলেটের মদনমোহন কলেজের ছাত্র ওয়াহিদুল ইসলাম অপু (২৬) ও সিলেটের দাড়িয়াপাড়ার বাসিন্দা শহীদুল ইসলাম। চতুর্থ ব্যক্তির নাম মাসুদ বলে জানা গেলেও প্রাথমিকভাবে তাঁর পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র জেদান আল মুসা সাংবাদিকদের জানান, মাসুদের পরিচয় পাওয়া যায়নি। তবে তাকে হামলাকারী বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
ওই ঘটনায় আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করার পর নিহত হয়েছেন আরো দুইজন।
রাত দুইটার দিকে জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আখতার হোসেন সাংবাদিকদরে জানান, চিকিৎসাধীন অবস্থায় জালালাবাদ থানার ওসি (তদন্ত) মনিরুল ইসলাম মারা গেছেন। তাঁকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।
এ ছাড়া চিকিৎসাধীন অবস্থায় সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলা ছাত্রলীগের উপ-পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক জান্নাতুল ফাহিমও নিহত হয়েছেন। তাঁর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি রাশেদুল ইসলাম।
বোমা বিস্ফোরণে আহতদের অধিকাংশকেই সিলেট ওসমানী ওসমানী মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, র্যাব, পুলিশের সদস্য ও সাধারণ মানুষসহ অন্তত ৫০ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে শিরিন মিয়া ও দক্ষিণ সুরমা থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) জনিলালের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে কর্ণেল আবুল কালাম আজাদের অবস্থাও সঙ্কটজনক। তাঁকে হেলিকপ্টারযোগে ঢাকার সম্মিলিত সামিরক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নিয়ে ভর্তি করা হয়েছে। আহতদের মধ্যে আরও আছেন র্যাব সদর দপ্তরের মেজর আজাদ।
কীভাবে এই বিস্ফোরণ ঘটে, সে বিষয়ে পুলিশের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ঢাকা থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দূরে এই আস্তানায় অভিযান চালাতে গত শুক্রবার সোয়াট সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে। শনিবার সকালে অভিযানে যোগ দেয় সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো দল। সন্ধ্যায় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে গণামধ্যমকে ব্রিফিং দেওয়ার পর দুটি বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
ঢাকা থেকে ঘটনাস্থলে যাওয়া একজন সাংবাদিকের বর্ণনা অনুযায়ী, দুই যুবক একটি মোটরসাইকেলে করে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে ব্রিফিংস্থলের কাছাকাছি পৌঁছালে প্রথম বিস্ফোরণটি ঘটে। বিস্ফোরণে দুই যুবক ছিটকে পড়ে যায়।
এর আগে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, আতিয়া মহলে বিস্ফোরক পেতে রাখা হয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর এ কারণেই অভিযান শেষ করতে সময় লাগছে।
সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়নের এই অভিযানের শুরুতে বাড়িটিতে থাকা জিম্মিদের উদ্ধার করা হয়। দিনভর চেষ্টায় ৭৮ জনকে বাড়িতে থেকে বের করা সম্ভব হয় বলে শনিবার সাড়ে ৬টার দিকে সাংবাদিকদের জানান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান।
আতিয়া ভবন থেকে ৩০ জন পুরুষ, ২৭ জন নারী ও ২১টি শিশুকে বের করে আনা হয়। বিদ্যুৎ, গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় প্রায় নয় ঘণ্টার বেশি সময় সেখানে ছিলেন তাঁরা।
ভবন থেকে বের হওয়া শাহনাজ পারভীন বেনারকে বলেন, ‘যেন নতুন জীবন ফিরে পেলাম। এই অবস্থায় যারা না পড়েছে তারা বুঝবে না আমরা কোথায়, কীভাবে ছিলাম।’
দুপুর পর্যন্ত মুহুর্মুহু গুলি
গতকাল সকালে অভিযান শুরু হয়। দুপুর ২টার পর থেকে অভিযান এলাকায় মুহুর্মুহু গুলির শব্দ পাওয়া যায়। এরপর পৌনে এক ঘণ্টায় অন্তত ছয়বার বিস্ফোরণের শব্দ হয়।
ঘণ্টা দুয়েক বিরতি দিয়ে বিকেল ৫টায় আবার দুটি বোমার শব্দ শোনা যায়। এরপরেই শুরু হয় মুহুর্মুহু গুলি। বিকেল পৌনে ছয়টা পর্যন্ত চলে এই গুলি। একসময় গুলি ও বোমার শব্দও থেমে যায়। এরপরেই সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন ফখরুল আহসান।
ভেতরে থাকা জঙ্গিরাই এই আইইডি (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছিল বলে জানান তিনি।
ভবনের ভেতরে কতজন জঙ্গি আছে, এরা কোন সংগঠনের বা তাদের শক্তিমত্তা কেমন সে বিষয়টিও নিশ্চিত করে জানাতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গতকাল সন্ধ্যায় ব্রিফিংয়ে সেনাবাহিনী জানায়, অভিযান চলমান রয়েছে।