আরও তিনটি জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযান, পাল্টা আক্রমণে জঙ্গিরা

জেসমিন পাপড়ি
2017.03.29
ঢাকা
সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানা থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে মাইকিং করে পুলিশ মৌলভীবাজারে বড়হাট এলাকায় সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানা থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে মাইকিং করে পুলিশ। ২৯ মার্চ, ২০১৭।
নিউজরুম ফটো

আপডেটঃ ২৯ মার্চ ২০১৭, ইস্টার্ন টাইম বিকেল ০৩.২০

বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের জঙ্গিরা। পাঁচ দিনব্যাপী শ্বাসরুদ্ধকর জঙ্গি বিরোধী অভিযান শেষ হওয়ার ১২ ঘণ্টা না পেরোতেই মৌলভীবাজারের দুটি স্থানে অভিযান চালাতে গেলে পাল্টা আক্রমণের শিকার হয়েছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

এদিকে গতকাল বিকেলে কুমিল্লায় আরও একটি জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পেয়ে অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে পুলিশ।

বুধবার ভোর থেকে মৌলভীবাজারের দুটি এলাকায় ভিন্ন দুটি বাড়ি ঘিরে রাখা হয়। যেখানে ১০-১২জন জঙ্গি অবস্থান করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদিন দুপুর থেকেই আবার কুমিল্লার কোটবাড়ী এলাকায় আরও একটি বাড়ি জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে ঘিরে রেখেছে পুলিশ। সেখানে বিস্ফোরকসহ কয়েকজন জঙ্গি অবস্থান করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগের দিনই এই জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পাওয়া গেল।

মৌলভীবাজারের সন্দেহভাজন ওই জঙ্গি আস্তানাগুলোতে অভিযান চালানোর পরিপ্রেক্ষিতে ওই দুটি এলাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করেছে প্রশাসন।

এর আগে গত ২৩ মার্চ গভীর রাত থেকে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ির আতিয়া মহল নামে এক বাড়ি ঘিরে অভিযান শুরু করেছিল পুলিশ। পরে শনিবার থেকে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে চূড়ান্ত ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ শুরু করে কমান্ডোরা। অভিযান চলাকালে ওই বাড়ির এক কিলোমিটারের মধ্যে দুই দফা বিস্ফোরণে দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ছয়জন নিহত হন। গুরুতর আহত হন আরও অনেকে। দীর্ঘ পাঁচ দিন পরে এক নারীসহ চার জঙ্গির লাশ উদ্ধারের মাধ্যমে মঙ্গলবার রাতে অভিযান সমাপ্ত করে সেনাবাহিনী।

আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে জঙ্গি নিহত হলেও তাদের মতাদর্শ টিকে থাকায় জঙ্গিবাদ নির্মূল হচ্ছে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। তা ছাড়া জঙ্গিবাদ নির্মূলে রাজনৈতিক ঐক্যের কথাও বলছেন তাঁরা।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মাহফুজুল হক মারজান বেনারকে বলেন, “জঙ্গি দমনের শর্টটার্ম পদ্ধতি হিসেবে পুলিশ নিয়মিতভাবে জঙ্গিদের হত্যা করছে। কিন্তু তাদের মতাদর্শ পাল্টাতে বিপরীতে পাল্টা মতাদর্শ আমরা দাঁড় করাতে পারিনি। যা দেখে তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পারবে। আর এ কারণে সঙ্গী হারানো জঙ্গিরা এখন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।”

নাসিরপুরে অভিযান শুরু, পাল্টা আক্রমণে জঙ্গিরা

মৌলভীবাজারে ঘিরে রাখা দুটি বাড়ির একটি পৌরসভার বড়হাট, অন্যটি সদর উপজেলার খলিলপুর ইউনিয়নের নাসিরপুর গ্রামে অবস্থিত। প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত বাড়ি দুটির মালিক একই পরিবারের লন্ডনপ্রবাসী দুজন সদস্য সাইফুল ইসলাম ও আতব্বর মিয়া।

দিনভর ঘিরে রাখার পরে বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টার দিকে নাসিরপুরের বাড়িটিতে সোয়াট ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্যরা ‘অপারেশন হিট ব্যাক’ নামে অভিযান শুরু করেছে বলে সাংবাদিকদের জানান সিলেট পুলিশের ডিআইজি কামরুল আহসান।

বিকেল থেকেই মৌলভীবাজারে বৃষ্টি পড়ছে। তার মধ্যেই বাগানঘেরা বাড়িটির দিক থেকে টানা গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে বলে জানান স্থানীয়রা।

নাসিরপুরে অভিযান চালানোর পাশাপাশি বড়হাট এলাকায় সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানাটিও ঘিরে রেখেছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। ঘিরে ফেলার পর থেকে সারা দিনই বাড়ি দুটি থেকে থেমে থেমে গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। ভেতর থেকে পুলিশের দিকে গুলি ও গ্রেনেড ছোড়া হচ্ছে।

পুলিশ, র‌্যাব, সোয়াট এবং কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পাশাপাশি প্রয়োজনে সেনাবাহিনী পাঠানোর কথাও জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

বুধবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, পুলিশের বিশেষ ইউনিট সোয়াটের সদস্যরা মৌলভীবাজারে গেছে, প্রয়োজন পড়লে সেনাবাহিনীও সম্পৃক্ত করা হবে।

এর আগে সিলেটে প্রাণহানি এড়াতে সেনাবাহিনীকে অধিকতর সতর্কতার সঙ্গে অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “আমরা চাই প্রাণহানি না ঘটুক। প্রাণহানি কমাতে যা করা প্রয়োজন তাই করব। প্রয়োজন হলে সেনাবাহিনী পাঠাব।”

অভিযানের অংশ হিসেবে বড়হাট ও সরকার বাজার এবং এর আশপাশের এলাকার গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে।

অভিযান শুরুর আগে মৌলভীবাজার পৌরসভার মেয়র ফজলুর রহমান বড়হাটের জঙ্গি আস্তানা এলাকা ঘুরে এসে সাংবাদিকদের বলেন, “জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানালে তারা গুলি ছুড়ে জবাব দেয়। সেখানে পুলিশ, র‍্যাব ছাড়াও সেনাবাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তা রয়েছেন।”

তবে অভিযান চলাকালে পুলিশের পক্ষ থেকে রাত ১২টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক ব্রিফিং দেওয়া হয়নি।

বড় জঙ্গি নেতা থাকতে পারে

মৌলভীবাজারের ঘিরে রাখা দুই বাড়িতে বড় কোনো জঙ্গি নেতা থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি সাংবাদিকদের জানান, “প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি শহর এলাকার বাড়িটিতে তারা (জঙ্গি) ৩-৪ জন থাকতে পারে। এ ছাড়া খলিলপুর ইউনিয়নে আরও দু’চারজন বেশি থাকতে পারে। সেখানে দু’একজন মহিলা সদস্য রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।”

দুই বাড়িতে ‘বিশেষ কেউ’ আছে কি না জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, “থাকতে পারে। প্রাথমিক ধারণাটা বললাম, তবে বড় কেউ (জঙ্গি) হয়ত থাকতে পারে।”

সীতাকুণ্ড ও সিলেটের মতো মৌলভীবাজারেও গোয়েন্দা তথ্যের আলোকে জঙ্গি আস্তানা ঘেরাও করা হয়েছে জানিয়ে দুপুরে মন্ত্রী বলেন, “বাড়িগুলো থেকে গোলাগুলি ও বোমা বিস্ফোরণ হচ্ছে। বিশেষ বাহিনী সোয়াট ও বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল পৌঁছানোর পরেই অভিযান শুরু হবে।”

সোয়া পাঁচটার দিকে ঘটনাস্থলে সোয়াট পৌঁছালে সন্ধ্যা সাড়ে সন্ধ্যা ছ’টায় অভিযান শুরুর খবর পাওয়া যায়।

১৪৪ ধারা জারি

মৌলভীবাজারে যে দুটি বাড়ি ঘিরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালাচ্ছে, সেই দুই এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে স্থানীয় প্রশাসন।

এ বিষয়ে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক তোফায়েল ইসলাম বেনারকে বলেন, “স্থানীয় বাসিন্দাদের নিরাপত্তার স্বার্থে বড়হাট পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ড ও কুসুমবাগ এলাকা এবং খলিলপুর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে আশপাশের দুই কিলোমিটার এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।”

এসব এলাকায় যানবাহন চলাচল এমনকি জনসাধারণের চলাচল নিয়ন্ত্রিত থাকলেও ওই এলাকা সংলগ্ন ঢাকা-মৌলভীবাজার মহাসড়কে যান চলাচলে কোনো সমস্যা নেই বলে জানান তিনি।

এ ছাড়া অভিযান সংক্রান্ত কার্যক্রমের ভিডিও ফুটেজ, ছবি বা সরাসরি সম্প্রচার থেকে বিরত থাকতে গণমাধ্যমগুলোর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স।

এ ধরনের প্রচারে পুলিশের অপারেশনাল কার্যক্রম দারুণভাবে ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি জনমনে ভীতি সঞ্চার এবং নিরাপত্তাহীনতাবোধ তৈরি হতে পারে বলে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে পাঠানো বিবৃতি বলা হয়।

যেভাবে শুরু

সাইফুর রহমানের মামাতো বোনের স্বামী জুয়েল বাড়ি দুটির তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি সাংবাদিকদের জানান, নাসিরপুরের বাড়িতে টিনের চালার তিনটি ঘরের একটিতে পরিবার নিয়ে নিজে থাকেন। বাকি দুটির একটিতে একজন রিকশাচালক অন্যটিতে গত জানুয়ারি মাসে ভাড়াটে ওঠে। মাহফুজ নামে নিজেকে একটি কোম্পানির ডিলার পরিচয় দেন ওই ভাড়াটিয়া।

নাসিরপুরের স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল আলিম টেলিফোনে বেনারকে জানান, লন্ডনপ্রবাসী সাইফুর রহমান ভোরে স্থানীয় নান্নু নামে একজনকে ফোন করে ওই বাড়ির ভাড়াটেকে ডাকতে বললে তিনি আমাদের পাঁচ-ছয়জনকে নিয়ে সেখানে যান। সঙ্গে পুলিশও ছিল। ভাড়াটে মাহফুজের ঘরে কল বেল দিলে ভেতর থেকে একজন দরজা খুলে পুলিশ দেখে সঙ্গে দরজা বন্ধ করেন।

পরে ভেতরে হাতুড়ি পেটানোর মতো শব্দ হলে পুলিশ উপস্থিত সবাইকে সরে যেতে বলে। এরপরেই ওই ঘর থেকে বিকট শব্দ শোনা যায়। তারপরে জুয়েল ও রিকশাচালকের পরিবারকে সরিয়ে নেওয়া হয়।

অভিযান শুরুর আগে ওই বাড়ির আশপাশের বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। অভিযান ঘিরে ওই এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে।

কুমিল্লার আস্তানায় বিস্ফোরকসহ জঙ্গি

এদিকে কুমিল্লার কোটবাড়ীর দক্ষিণ বাগমারা বড় কবরস্থানের পাশে তিন তলা যে বাড়িটি পুলিশ ঘিরে রেখেছে সেখানে বিস্ফোরকসহ কয়েকজন জঙ্গি থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করছে পুলিশ।

তবে বৃহস্পতিবার কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন থাকায় এখনই কোটবাড়ি এলাকায় ঘিরে রাখা বাড়িটিতে কোনো অভিযান চালানো হবে না বলে জানিয়েছে পুলিশ।

এ বিষয়ে পুলিশ সুপার মো. শাহ আবিদ হোসেন বলেন, “বাড়িটি  ঘেরাও করে রাখা হয়েছে। আশপাশের লোকজনদেরও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। শুক্রবার থেকে অভিযান চালানো হবে।”

কুমিল্লার এসপি শাহ মো. আবিদ হোসেন সাংবাদিকদের জানান, “বুধবার দুপুরে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্যরা বাড়িটি ঘিরে ফেলে। বাড়িটিতে কয়েকজন জঙ্গি আছে। তাদের কাছে বোমা থাকতে পারে বলেও আমরা ধারণা করছি।”

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ বাগমারা এলাকার বড় কবরস্থান সংলগ্ন এই বাড়িটি জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে ঘিরে রাখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ২৯ মার্চ, ২০১৭
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ বাগমারা এলাকার বড় কবরস্থান সংলগ্ন এই বাড়িটি জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে ঘিরে রাখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ২৯ মার্চ, ২০১৭
[স্টার মেইল]
কোটবাড়ী এলাকার দেলোয়ার হোসেন নামের এক ব্যক্তির মালিকানাধীন এই বাড়িটির পাশেই গন্ধমতী হাই স্কুল বৃহস্পতিবার সিটি নির্বাচনের একটি কেন্দ্র।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।