বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে জঙ্গিরা এখন আরো শক্তিশালি, বেশি বিপজ্জনক

প্রাপ্তি রহমান ও কামরান রেজা চৌধুরী
2017.04.13
ঢাকা
সিলেটে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের সময় সেনা সদস্যরা ভবনের বাসিন্দাদের উদ্ধার করছেন। সিলেটে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের সময় সেনা সদস্যরা ভবনের বাসিন্দাদের উদ্ধার করছেন। মার্চ ২৬, ২০১৭।
AFP

জঙ্গিবাদ সংশ্লিষ্ট ঘটনায় মার্চ ছিল একটি রক্তাক্ত মাস। এই এক মাসে জঙ্গি আক্রমণ ও জঙ্গিবিরোধী অভিযানে বাংলাদেশে নিহতের সংখ্যা ২০১৬’র জুলাইতে হলি আর্টিজানে ইসলামিক স্টেট সমর্থিত হামলায় ২৯ জনের মৃত্যু ঘটনার পর সর্বোচ্চ।

মার্চের ৬ তারিখ থেকে শুরু হওয়া বোমা বিস্ফোরণ, গ্রেনেড হামলা ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে ৩০ জনের মৃত্যু হয়। যার মধ্যে রয়েছে আঠারোজন সন্দেহভাজন জঙ্গি, তিনজন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য ও পাঁচটি শিশু (ঘটনাক্রম দেখুন)।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে দেশে জঙ্গিরা এখন আরো বেশি সংগঠিত ও শক্তিশালী। তারা এখন নতুন কৌশলের সাথে অনেক বেশি শক্তিশালী বিস্ফোরক ব্যবহার করছে। এছাড়া, নিহত জঙ্গিদের ১০জনই ছিল আত্মঘাতী, যা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নতুন ধরনের ঘটনা।

এ প্রসঙ্গে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. ছানোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “এর আগে জেএমবি যে ধরনের বোমা ব্যবহার করেছে, এবারের বোমাগুলো তার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী।”

জঙ্গিদের আত্মঘাতী বোমা ব্যবহারের কৌশল স্থানীয় জঙ্গিদের সাথে তথাকথিত ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গিদের যোগাযোগ থাকার একটি প্রমাণ বলে মনে করেন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদ। নূর মোহাম্মদের সাবেক কর্মস্থল রাজশাহী থেকেই উত্থান হয়েছিল নিষিদ্ধ ঘোষিত জামাত-উল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) এর।

“জেএমবি আইএস এর ধ্বংসাত্মক আদর্শ গ্রহণ করেছে। এখন তারা আইএস এর মতো ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে তরুণদের বোঝাচ্ছে যে, তারা যদি ইসলামের জন্য আত্মঘাতী বোমায় নিহত হয় তবে সরাসরি বেহেস্তে চলে যাবে,” বেনারকে বলেন নূর মোহাম্মদ।

তিনি বলেন, “এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে জেএমবি জঙ্গিদের সাথে আইএস এর যোগাযোগ আছে।”

ছানোয়ার হোসেন জানান, গত ২৪ মার্চ বিমানবন্দর সড়কে বোমা বিস্ফোরণের পর ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ যে ব্যাগ উদ্ধার করে, তার ভেতর ১০ কেজি ওজনের একটি বোমা ছিল। বোমা বহনকারী তরুণ বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তার শরীরে বেঁধে রাখা বোমার বিস্ফোরণে। ওই ঘটনায় আর কেউ আহত বা নিহত না হলেও ব্যাগে থাকা বোমাটি নিষ্ক্রিয় করার সময় কমপক্ষে ছয়জন পুলিশ সদস্য আহত হন।

এ প্রসঙ্গে নিরাপত্তা বিশ্লেষক, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, “জঙ্গিরা নতুন শক্তি নিয়ে আবার সংগঠিত হচ্ছে। এরা নির্মূল হয়নি, বরং হলি আর্টিজান ঘটনার পর অব্যাহত পুলিশি অভিযানের প্রেক্ষিতে তারা সাময়িক গা ঢাকা দিয়েছিল।”

নতুন মুসার উত্থান হতে পারে

২০১৬ সালের জুলাইতে হলি আর্টিজান হামলার পরবর্তীতে নিরাপত্তা বাহিনীর ১৬টি জঙ্গিবিরোধী অভিযানে মোট ৫৯জন সন্দেহভাজন জঙ্গি নিহত হয়।

যার মধ্যে গত আগস্টে পুলিশি অভিযানে নিহত হলি আর্টিজান হামলার কথিত মূল হোতা তামিম চৌধুরীও একজন। তামিম চৌধুরী আইএস এর আদর্শ অনুযায়ী জেএমবির একটি অংশকে নিয়ে নব্য জেএমবি গঠন করে।

পুলিশের সূত্রমতে, তামিম পরবর্তী নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা মইনুল ইসলাম ওরফে মুসা গত মার্চে সিলেটের জঙ্গি আস্তানায় ৭২ ঘণ্টার অভিযানে নিহত হয়।

“মুসার হত্যা জঙ্গিদের ওপর একটি বড়ো আঘাত সত্য, কিন্তু ভবিষ্যতে আরো নতুন মুসার উত্থান হতে পারে,” নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা।

পুলিশ জানায়, গত মাসে অভিযানকালে সীতাকুণ্ড, সিলেট, মৌলভীবাজার ও কুমিল্লার নব্য জেএমবির আস্তানাগুলোতে বিপুল পরিমাণ বোমা ও বিষ্ফোরকের মজুত পাওয়া গেছে।

গোয়েন্দা তথ্যের বরাত দিয়ে পুলিশের একটি সূত্র জানায়, তামিম চৌধুরীর মৃত্যুর পর নব্য জেএমবি এখন আগের চেয়ে বেশি সংগঠিত। বোমা বানানো ও দল গোছানোর জন্য দলটি দুজন বিশেষজ্ঞ নেতা পেয়েছে, যাদের সিরিয়ায় কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। যত দূর জানা গেছে, ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে তারা নতুন করে বেশ কিছু সদস্য নিয়োগ দিয়েছে।

নব্য জেএমবির উত্থান

বাংলাদেশে শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য নিয়ে ২০০৩ সালে গঠিত জেএমবি থেকে পরবর্তীতে তৈরি হওয়া একটি দল নব্য জেএমবি। ২০০৫ সালে জেএমবি সারা দেশে এক সাথে ৬০০টি বোমা বিষ্ফোরণ ঘটায়, যদিও তাতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল মাত্র দুই।

ওই বিষ্ফোরণ ঘটনায় ২০০৭ সালে জেএমবির প্রতিষ্ঠাতা শেখ আব্দুর রহমান ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইএর মৃত্যুদণ্ড হবার পর জেএমবি গা ঢাকা দেয়।

“কিন্তু তাই বলে তারা শেষ হয়ে যায়নি। পূর্ণ শক্তি নিয়ে তারা হাজির হয়েছে আবার। শুধু জেএমবি নয়, বাংলাদেশে আল কায়েদার সমর্থক আনসারুল্লাহ বাংলা টিম অত্যন্ত শক্তিশালী ও সক্রিয়,” বেনারকে বলেন বাংলাদেশ পিস অ্যান্ড সিকিউরিটিজ স্টাডিজের রিসার্চ ফেলো শাফকাত মুনীর।

প্রসঙ্গত বাংলাদেশে ২০১৩’র ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৬’র মে পর্যন্ত মুক্তমনা ব্লগার, বুদ্ধিজীবী ও সমকামী ব্যক্তিদের হত্যার জন্য বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে দায়ী করে থাকে।

তবে বাংলাদেশে জঙ্গি বিরোধী অভিযানে গ্রেপ্তারের চেয়ে জঙ্গিদের নিহত হবার ঘটনা বেশি হলেও পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলামের মতে, এভাবে জঙ্গিবাদ দমন সম্ভব নয়।

তিনি বেনারকে বলেন, দেশে জঙ্গিবাদ বিরোধী কাজ শুধু পুলিশি অভিযানের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এভাবে জঙ্গিবাদ দমন করা যাবে না।

“ধর্ম, তথ্য, শিক্ষা, তথ্য, সংস্কৃতি সব মন্ত্রণালয়কে একযোগে কাজ করতে হবে। কারাগারের ভেতরে যারা আছে তাদের জন্য আলাদা কর্মসূচি দরকার,” বেনারকে বলেন মনিরুল ইসলাম।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।