আনসারুল্লাহ’র আইটি প্রধান ও জঙ্গি জিয়ার সহযোগী আরিফ গ্রেপ্তার

জেসমিন পাপড়ি
2017.05.02
ঢাকা
এবিটির তথ্যপ্রযুক্তি শাখার প্রধানকে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করে পুলিশ। এবিটির তথ্যপ্রযুক্তি শাখার প্রধানকে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করে পুলিশ। মে ০২, ২০১৭।
নিউজরুম ফটো

নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) সামরিক বিভাগের তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) শাখার প্রধানকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট।

আশফাকুর রহমান অয়ন ওরফে আরিফ নামের ওই ব্যক্তি এবিটি’র সামরিক শাখার প্রধান পলাতক মেজর (বরখাস্ত) সৈয়দ মো. জিয়াউল হকের ঘনিষ্ঠ সহযোগী বলেও জানানো হয়েছে।

পুলিশ জানায়, নিজের প্রযুক্তি জ্ঞান কাজে লাগিয়ে আশফাক ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে ব্লগারদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করত। পরে ওই ব্লগারদের ওপর হামলা করা হতো।

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ভাটারা থানার নর্দা এলাকা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে বেনারকে জানান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান। পরে পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে তাঁর পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে ঢাকার আদালত।

সন্ত্রাসী সংগঠন এবিটি’র একজন শীর্ষ নেতাকে আটক করার বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকেরা। যদিও পুলিশের দাবির সত্যতা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মাহফুজুল হক মারজান বেনারকে বলেন, “এবিটি’র আইটি প্রধানকে ধরতে পারা নিঃসন্দেহে ভাল খবর। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।”

তাঁর মতে, “একজনকে আটক করে তাঁদের দুর্বল করা যাবে না। কারণ, এ ধরনের কর্মীর ব্যাকআপ তাঁদের থাকে। এখন পর্যন্ত মেজর জিয়াও আটক হয়নি। এ জন্য আরো বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।”

তাঁর মতে, আশফাকের মাধ্যমে মেজর জিয়ার কাছাকাছি পৌঁছানো কঠিন। কারণ, সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা অনেক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তার মেথডলজিও খুব ভিন্ন বলে মনে হয়।”

জঙ্গিবাদ বিশ্লেষক নূর খান বেনারকে বলেন, “প্রতিনিয়ত পুলিশ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সদস্য কিংবা শীর্ষ নেতা আটকের খবর জানায়। বিষয়গুলো অন্য কোনো মাধ্যমে যাচাই করার সুযোগ না থাকায় পুলিশের ওপরই আমাদের বিশ্বাস করতে হচ্ছে।”

মেজর জিয়ার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ছিল

মঙ্গলবার দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আশফাককে হাজির করে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের ব্রিফ করা হয়।

ব্রিফিংয়ে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, আশফাক এবিটির সামরিক বিভাগের আইটি বিভাগের প্রধান। সে চাকরিচ্যুত ও পলাতক সেনা কর্মকর্তা জিয়ার ঘনিষ্ঠ সহযোগী। কয়েক মাস আগে ঢাকার বাইরে জিয়ার সঙ্গে দেখা করে আশফাক। দু’মাস আগেও তাদের মধ্যে যোগাযোগ হয়েছিল।”

“সংগঠনের আরেকজনের সঙ্গে দেখা করতে আশফাক সিলেট থেকে ঢাকায় এসেছিল। এরপর গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়,” জানান তিনি।

২০১৫ সালের মে মাসে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হয়। সন্ত্রাসবিরোধী আইন অনুযায়ী সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করে সরকার।

এর আগে ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যাকাণ্ডের পর এবিটি’র তৎপরতার খবর উঠে আসে। ওই মামলার রায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে বর্তমানে কারা ভোগ করছেন সংগঠনটির আমির মুফতি জসীমউদ্দীন। লেখক অভিজিৎ রায় হত্যাসহ বেশ কয়েকটি জঙ্গি হামলা ও হত্যার ঘটনায় এই সংগঠনটি জড়িত বলে ধারণা করছে গোয়েন্দারা।

সংবাদ সম্মেলনে মনিরুল ইসলাম বলেন, “গ্রেপ্তারের সময় আশফাকের কাছ থেকে ল্যাপটপ, মোবাইল সেট, আল-কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেনের জিহাদি প্রবন্ধ, আল-কায়েদা আরব উপদ্বীপের নেতা ইয়েমেনের আনোয়ার আল আওলাকির বক্তব্য ও ব্লগার হত্যার প্রশিক্ষণের বিষয়বস্তু উদ্ধার করা হয়েছে।”

কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান বলেন, “প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ২০১৪ সালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগে পড়াকালীন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে সে এবিটি’র সামরিক বিভাগে যোগ দেয়।”

মনিরুল ইসলাম জানান, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের বহুল আলোচিত মেজর জিয়ার অধীনে ও পরিচালনায় রাজধানীর উত্তরায় ও পল্লবীর কালাপানি এলাকায় নাস্তিক ব্লগার হত্যা সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশিক্ষণে অংশ নেয় আশফাক। পরবর্তী সময়ে সে এবিটি’র সামরিক বিভাগের আইটি শাখার প্রধান হিসাবে নিযুক্ত হয়।

কাউন্টার টেররিজম ইউনিট জানায়, আটক এবিটি নেতা ‘মুসলিমদের রক্তের পবিত্রতা’, ‘স্পেন বিজয়ে তারিক বিন জিয়াদ এর বক্তব্য’, ‘আমেরিকার জুলুম’ সহ ধর্মীয় উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধকরণ বিষয়ে বিভিন্ন লেখনী বাংলায় অনুবাদ করে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারের ব্যবস্থা করে। মেজর জিয়ার সরাসরি তত্ত্বাবধানে ‘দাওয়া ইল্লাল্লাহ’ ওয়েব পেইজে ধর্মীয় উগ্রবাদ বক্তব্য সংবলিত বিভিন্ন আর্টিকেল সে নিয়মিত আপলোড করত।

প্রসঙ্গত, দাওয়া ইল্লাল্লাহ পেজের মাধ্যমে সদস্য সংগ্রহের কাজ করত এবিটি। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় পেজটি বন্ধ করা হয়েছে।

ভিন্ন নামে কার্যক্রম চলার আশঙ্কা

অপরাধ বিশেষজ্ঞ মাহফুজুল হক মারজানের মতে, আনসারউল্লাহ বাংলা টিম আলকায়দা’র ভারতীয় উপমহাদেশ শাখার বাংলাদেশ অংশ হয়ে কাজ করে। ব্লগার হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে বেশ কিছু বড় হামলার ঘটনায় তাদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। নব্য জেএমবির চেয়েও এদের কার্যপরিধি বিস্তৃত। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী নব্য জেএমবি’র দিকে যতটা মনোযোগী ছিল, ততটাই অমনোযোগী ছিল এবিটি নিয়ে। এই সুযোগে ভিন্ন নামে তারা সংগঠনের কার্যক্রম চালাতে পারে।

তিনি বলেন, “তারা (এবিটি) ইন্টারনেটে ভীষণ সক্রিয়। দাওয়ায়ে ইল্লাল্লাহ বন্ধ হলেও ভিন্ন নামে তারা ইউটিউবে, ফেসবুকে কার্যক্রম চালাচ্ছে। বিভিন্ন ব্লগে ভিডিও আপলোডের মাধ্যমে সদস্য সংগ্রহ করে। এসব বিষয়েও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নজর দেওয়া জরুরি।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।