ঝিনাইদহে অপারেশন ‘শাটল স্প্লিট’: দুই জঙ্গি নিহত, আহত দুই পুলিশ
2017.05.07
ঢাকা

ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার বজরাপুর গ্রামের একটি জঙ্গি আস্তানায় পুলিশি অভিযানে দুই জঙ্গি নিহত ও তিনজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। ওই অভিযানে আহত হয়েছেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের একজন কর্মকর্তাসহ দুই পুলিশ সদস্য। তাঁরা এখন আশঙ্কামুক্ত।
১৭ দিনের ব্যবধানে পুলিশ আবারও ঝিনাইদহে অভিযান চালাল। এর আগে গত ২১ এপ্রিল ঝিনাইদহের সদর উপজেলার পোড়াহাটি গ্রামে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলা বারুদ উদ্ধার করলেও পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। ওই আস্তানায় থাকা লোকজন আগেই সটকে পড়ে।
ঢাকায় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, গত ৫ মে তাঁরা ঝিনাইদহ থেকে শামীম নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেন। ওই শামীমই তাঁদের ঝিনাইদহে নিজ বাড়িতে বিস্ফোরক রাখার খবর দেন।
তিনি জানান, শামীমের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই উপজেলার বজরাপুর গ্রামের অপর একটি আস্তানার খবর পায় পুলিশ। রাতেই কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের অতিরিক্ত উপকমিশনার নাজমুল করিমের নেতৃত্বে একটি দল রওনা হয়। ভোর থেকে শুরু হয় অভিযান।
অভিযানটির নামকরণ করা হয়েছে ‘অপারেশন শাটল স্প্লিট’। ওই অভিযানে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ও স্থানীয় পুলিশ অংশ নেন। পরে যোগ দেয় বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল।
অভিযানে নাজমুল করিমের ডান হাত বোমার আঘাতে ভেঙে গেছে। এ ছাড়া মহেশপুর থানার উপপরিদর্শক মো. মহসিনের মাথায় স্প্লিন্টারের আঘাত লাগে। দুজনেই এখন শঙ্কামুক্ত বলে জানা গেছে।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বজরাপুর গ্রামে ওই বাড়ির চারপাশে ১৪৪ ধারা জারি ছিল। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন জহুরুল ইসলাম, তাঁর ছেলে জসিম উদ্দিন ও জহুরুল ইসলামের বাড়ির ভাড়াটিয়া আলমগীর হোসেন। নিহত দুজনের একজনের নাম তুহিন বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে।
“জহুরুল ইসলাম ও তাঁর ছেলে জসিম উদ্দীন দুজনেই জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ। তাঁরা তাঁদের বাড়িতে বহিরাগত জঙ্গিদের আশ্রয় দিতেন। তাঁরা সবাই নব্য জেএমবির সদস্য,” সংবাদ সম্মেলনে মনিরুল ইসলাম বলেন।
বজরাপুর গ্রামের বাসিন্দারা বলেন, ভোরবেলা তাঁরা তাঁদের গ্রামে প্রচুর পুলিশ দেখতে পান। পরে শোনেন জহুরুল ইসলামের বাড়িতে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। প্রথমে তাঁরা বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসলেও পরে পুলিশ তাঁদের বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ কোনো জায়গায় চলে যাওয়ার পরামর্শ দেয়।
যেভাবে অভিযান
প্রথমে শামীমের কথার সূত্র ধরে লেবুতলার মৃত শরাফত আলীর বাড়িতে অভিযান চালানো হয়। ওই অভিযানে বেশ কিছু অস্ত্র উদ্ধার হয়। পরে ওই অভিযানটি স্থগিত রেখে বজরাপুর গ্রামে অভিযানে নামে পুলিশ।
অভিযানে অংশগ্রহণকারী এক পুলিশ সদস্য বলেন, তাঁরা জঙ্গি আস্তানায় গুলি ছোড়েন। তখন ভেতর থেকেও গুলি ও বোমা ছোড়ে জঙ্গিরা। একপর্যায়ে পুলিশ ভেতরে ঢুকে পড়ে। তখন জঙ্গিরাও তাদের দিকে সুইসাইডাল ভেস্ট পরে এগিয়ে আসে।
কাউন্টার টেররিজম প্রধান বলেন, বজরাপুর গ্রামের জহুরুল ইসলামের বাড়িতে ঢোকার পর সুইসাইডাল ভেস্ট পরা এক জঙ্গি পুলিশের দিকে এগিয়ে আসে। তখন তাকে উদ্দেশ্য করে পুলিশ গুলি ছোড়ে। সুইসাইডাল ভেস্টের বিস্ফোরণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে, না কি সে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে এখনো বোঝা যাচ্ছে না।
“পরে সুইসাইডাল ভেস্ট পরে আরেক জঙ্গি মহেশপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে। ওসি তাঁকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে আসতে থাকেন। সেসময় ওই জঙ্গিও তাঁর পিছু নেয়। ওসি নিরাপদ দূরত্বে সরে আসলেও কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বোমাটা ফেটে যায়। এতে নাজমুল করিম ও মো. মহসিন আহত হন,” জানান মনিরুল।
রাত পৌনে ৯টায় অভিযানের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে। ঘটনাস্থলে চারটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। উদ্ধার হয় দুটি আগ্নেয়াস্ত্র।
খুলনা রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক দেদার আহম্মেদ রাতে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বজরাপুরের অভিযান শেষ। কাল (সোমবার) সকাল থেকে শুরু হবে লেবুতলার অভিযান।
জহুরুল ও শামীমের পরিচয়
স্থানীয় বাসিন্দা রিটন হোসেনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে জহুরুল ইসলাম পেশায় একজন চা বিক্রেতা। ইদানীং তিনি বাসায় মিষ্টি জাতীয় খাবার তৈরি করে দোকানে দোকানে সরবরাহ করতেন। এলাকার লোকজনের সঙ্গে মিশতেন না। কারও সঙ্গে ঝগড়া বিবাদও ছিল না।
“তার নামাজ পড়ার ধরন আলাদা ছিল। গ্রামের লোকজনের সঙ্গে এক মসজিদে নামাজ পড়তেন না। তাঁর বাড়িতেও কাউকে ঢুকতে দেওয়া হতো না। তাঁর উঁচু পাঁচিল দেওয়া বাড়িতে কারও প্রবেশাধিকার ছিল না,” রিটন বেনারকে বলেন।
শামীম সাংগঠনিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন বলে ধারণা করছে পুলিশ। ঝিনাইদহে হলি আর্টিজানে হামলাকারী নিবরাস ইসলামের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মনিরুল ইসলাম বলেন, কৌশলগত কারণে সীমান্তবর্তী এলাকায় জঙ্গিদের উপস্থিতি বেশি। কারণ সীমান্ত এলাকা থেকে বিস্ফোরক সংগ্রহ এবং ঘটনা ঘটিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ বেশি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জঙ্গিদের বাসা ভাড়া পেতে ইদানীং সমস্যা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, বাড়ির মালিক নিজেই জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ। তারা বাড়িতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা করছে এবং বহিরাগতদের আশ্রয় দিচ্ছে। ঝিনাইদহে তা-ই ঘটেছে।
মনিরুল বেনারকে বলেন, “আশা করছি বছর দেড়েকের মধ্যে নব্য জেএমবি পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হবে। এখন পর্যন্ত পুরনো জেএমবির তৎপরতা ছিল এমন জায়গাগুলোয় তাদের কিছু কার্যক্রম আছে। সেটি নিয়ন্ত্রণে অভিযান অব্যাহত থাকবে।”