রাজশাহীতে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে ফায়ার সার্ভিস কর্মীসহ নিহত ৬
2017.05.11
ঢাকা

রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলায় জঙ্গিবাদ বিরোধী অভিযানে পাঁচজন জঙ্গি নিহত হয়েছে। এ সময় জঙ্গিদের হামলায় ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মী নিহত ও আহত হয়েছেন পুলিশের চার সদস্য।
ঝিনাইদহে অভিযানের তিনদিনের মাথায় এ অভিযানটি পরিচালিত হলো।
গোদাগাড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কমকর্তা (ওসি) হিফজুর আলম মুন্সী সাংবাদিকদের বলেন, “নিহতদের পাঁচজন 'জঙ্গি'। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে জঙ্গিরা আত্মঘাতী বোমার বিস্ফেরেণে নিহত হয়েছে। জঙ্গি আস্তানা থেকে এক নারী ও দুই শিশুকে উদ্ধার করা হয়েছে।”
নিহত জঙ্গিরা জেএমবির সদস্য বলে জানান ওসি হিফজুর।
ফায়ার সার্ভিসের নিহত কর্মীর নাম আবদুল মতিন। তাঁর বাড়িও গোদাগাড়ি উপজেলার মাটিকাটা ইউনিয়নে। আহত পুলিশ সদস্য উৎপল ও তাইজুলকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। অপর দুজনের নাম এখনও জানা যায়নি।
গোদাগাড়ি উপজেলার মাটিকাটা ইউনিয়নের বেণীপুর গ্রামের আস্তানায় বুধবার দিবাগত রাত থেকে অভিযান শুরু হয়। দুপুরের দিকে ঘটনাস্থলের কাছাকাছি যান গোদাগাড়ির পৌর মেয়র মনিরুল ইসলাম। ফিরে এসে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আস্তানার ভেতর কেবল ধ্বংসের চিহ্ন। পাঁচজনের লাশ পড়ে আছে।”
বাড়িটিতে ঠিক কতজন ছিলেন এমন প্রশ্নের জবাবে গোদাগাড়ির উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম বলেন, “এখনও এই সংখ্যা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে নিহতদের তিনজন পুরুষ এবং দুজন নারী। তাছাড়া আস্তানা থেকে একজন নারী ও দুটি শিশুকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে।”
নিহত জঙ্গিরা ওই এলাকারই বাসিন্দা বলে নিশ্চিত করেছেন জাহিদুল।
এদিকে পুলিশ ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিহত পাঁচজনের চারজনই এক পরিবারের সদস্য। পরিবারের কর্তা সাজ্জাদ হোসেন (৫০) একসময় জামাতে ইসলামির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার স্ত্রী বেলি বেগম, ছেলে আল আমিন, মেয়ে করিমা খাতুন গতকাল বৃহস্পতিবার পুলিশি অভিযানে মারা যান।
ওই অভিযানে একজন বহিরাগতও নিহত হয়েছেন। প্রাথমিকভাবে তার নাম আশরাফুল বলে জানা গেছে।
আস্তানাটি যে জমির ওপর সেটি বেলি বেগম তাঁর বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন। এতকাল ফাঁকা পড়ে থাকলেও মাস দুয়েক আগে প্রায় জনশূন্য জায়গাটিতে তারা বাড়ি করেন বলে জানান জাহিদুল ইসলাম।
ফায়ার সার্ভিস সদস্যকে কুপিয়ে হত্যা
রাজশাহী জেলা পুলিশ, পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম, পুলিশ সদর দপ্তরের এলআইসি শাখা এবং ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের একটি দল বুধবার দিবাগত রাত একটার দিকে বেণীপুর গ্রামের আস্তানাটি ঘিরে ফেলে।
গোদাগাড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিফজুর আলম মুন্সী বলেন, রাত থেকেই তাঁরা বারবার আস্তানার ভেতরে থাকা লোকজনকে বেরিয়ে আসার অনুরোধ জানান। তারা সাড়া দেয়নি। ভোরের দিকে পুলিশ শটগান থেকে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। তারপরও অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। পুলিশের সঙ্গে অভিযানে ছিল ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সদস্যরা। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন পানি ছুড়ে মাটির দেওয়ালটাকে দুর্বল করে ফেলতে। তখনই আচমকা বেরিয়ে আসে জঙ্গিরা।
“দেওয়ালটা তিন-চার ইঞ্চি পুরু ছিল। ফায়ার সার্ভিস সামনে। আমরা ঠিক পেছনে। হঠাৎ কয়েকজন সুইসাইডাল ভেস্ট পরে, হাতে হাঁসুয়া (বড় দা) নিয়ে বেরিয়ে আসে। একজন মতিনকে জড়িয়ে ধরে ও এলোপাথাড়ি কোপাতে থাকে। বোমাও বিস্ফোরণ ঘটায়। অন্যরা সরে আসতে পারলেও ফায়ার সার্ভিসের একজন পারেননি,” হিফজুর বলেন।
ওই সময়ই বোমার স্প্লিন্টারের আঘাতে চার পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন বলে জানান হিফজুর।
তিনি আরও বলেন পরিস্থিতি তখন এমন ছিল যে গুলি ছুড়লে ফায়ার সার্ভিসের আরও অনেকে গুলিবিদ্ধ হতেন।
‘জঙ্গি' সুমাইয়ার আত্মসমর্পণ
এই অভিযানে একজন জঙ্গি আত্মসমর্পণ করে। তার নাম সুমাইয়া বলে জানান রাজশাহীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুমিত চৌধুরী।
অভিযান শুরুর পর সকালেই পাঁচবছরের একটি শিশু ও মাস তিনেক বয়সী একটি শিশুকে কোলে করে জঙ্গি আস্তানা থেকে বেরিয়ে আসে সুমাইয়া।
“সকাল থেকেই সুমাইয়াকে আত্মসমর্পণের অনুরোধ করা হচ্ছিল। সেও অন্যান্যদের মতো সুইসাইডাল ভেস্ট পরেছিল। অভিযানে নিহত জঙ্গিদের লাশের সামনে সে বসেছিল। পরে সকাল ১০টা ৪০ মিনিটের দিকে সুমাইয়া আত্মসমর্পণ করে,” সাংবাদিকদের বলেন সুমিত।
পরে শিশু দুটিকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে উদ্ধার হওয়া শিশু দুটির মা সুমাইয়া।
গোদাগাড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিফজুর আলম মুন্সী জানান, সুমাইয়ার স্বামী জহুরুল ইসলামের সঙ্গে নব্য জেএমবির সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠে। মাস ছয়েক আগে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। বর্তমানে জহুরুল কাশিমপুর কারাগারে আছে।
পুরানো জেএমবির ঘাঁটিগুলো নিশ্চিহ্ন হয়নি
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলামের মতে, জেএমবির উৎপাত ২০০৭ পর্যন্ত যেসব অঞ্চলে ছিল, সেসব জায়গা এখনও জেএমবির প্রভাবমুক্ত হয়নি। সেসব জায়গায় এখনও জেএমবির সমর্থকরা রয়েছে।
“বগুড়া, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি জেলায় জেএমবির তৎপরতা ছিল। ধারাবাহিক অভিযানে ২০০৭-এর পর তারা চুপসে গিয়েছিল। এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি, তারা নিষ্ক্রিয় হয়নি," এক প্রশ্নের উত্তরে গত ৮ মে বেনারকে বলেন মনিরুল।
তিনি আরও বলেন, “জঙ্গিরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে বলেই আত্মঘাতী হামলায় যাচ্ছে। একটা সময় তারা হিযরত করত, এখন নিজ বাড়িতেই গোলাবারুদ নিয়ে থাকছে।”
তিনি আশা করেন, বছর দেড়েকের মধ্যে সংগঠন হিসেবে জেএমবির মৃত্যু হবে।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জিম্মি করে ১৮ বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে পুলিশ ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জঙ্গিবিরোধী বিভিন্ন অভিযানে এখন পর্যন্ত জেএমবি ও নব্য জেএমবির অন্তত ৭০জন জঙ্গি নিহত হয়েছেন।