হলি আর্টিজানে হামলাকারীদের সঙ্গে জঙ্গি নিলয়ের ঘনিষ্ঠতা ছিল
2018.05.11
ঢাকা

গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলাকারী তরুণদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল নব্য জেএমবির অন্যতম নেতা আকরাম হোসেন খান নিলয়ের (২৯)। এই তরুণেরা গুলশানের একটি মসজিদে সাংগঠনিক কাজে নিয়মিত একত্রিত হতো। তাদের এক মঞ্চে আনার কাজটি করেছিল হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার মূল পরিকল্পনাকারী তামিম চৌধুরী।
নিলয়কে জিজ্ঞাসাবাদে জড়িত পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইমের কর্মকর্তারা এসব তথ্য জানিয়েছেন। তিন দফায় ১৩ দিন রিমান্ডে থাকার পর নিলয় এখন কারাগারে।
নিলয় হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পরিকল্পনা সম্পর্কে কতটুকু জানত? তার ভূমিকা কী ছিল?—এসব প্রশ্নের জবাবে ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ ও গণমাধ্যম বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বেনারকে বলেন, “এটি স্পষ্ট যে, সে ঢাকার পান্থপথে হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে একজন জঙ্গিকে অবস্থান নিতে ও হামলা চালানোর পরিকল্পনা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।”
মাসুদ আরও বলেন, নিলয় সম্পর্কে তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। হলি আর্টিজান মামলার অভিযোগপত্র তৈরির কাজও চলছে।
এদিকে তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, নিলয়কে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। খুব শিগগির অন্য একটি মামলায় তাকে রিমান্ডে আনার চেষ্টা করবে পুলিশ।
২০১৭ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে সরকার ঘোষিত জাতীয় শোক দিবসের র্যালিতে বোমা হামলা চেষ্টার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে নিলয়ের নাম পেয়েছেন তদন্তকারীরা। সাত মাসের চেষ্টায় বগুড়া থেকে গত ২১ মার্চ রাতে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।
এদিকে নিলয়ের মাধ্যমে ঢাকার আরও বেশ কিছু ধনাঢ্য ও উচ্চশিক্ষিত তরুণ জঙ্গিবাদে ঝুঁকেছে বলে খবর পাচ্ছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। তাদের মধ্যে বেশ কিছু নারীও রয়েছেন।
এসব নারীদের একজন হোমায়রা ওরফে নাবিলাকে (২৭) পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে মাসখানেক আগে। সেও এখন কারাগারে। জিজ্ঞাসাবাদে নাবিলার কাছ থেকে এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য তথ্য পায়নি পুলিশ।
হোলি আর্টিজানে হামলার পাঁচ মাস আগে ২০১৬ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ থানায় নিবরাস ইসলামসহ নয়জনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা হয়েছিল। ওই মামলার আসামি শাম্মুর রাইয়ানের মাধ্যমে নিলয়ের সঙ্গে নাবিলার পরিচয় হয় বলে জানতে পেরেছে পুলিশ।
“নিলয়ের বাবা-মা ও বোনও বেশ কিছুদিন সিরিয়া যাওয়ার লক্ষ্যে ভারতে ছিল। তারাও এখন পুলিশের হেফাজতে। নিলয়ের বোন শুভ (২৫) নব্য জেএমবির নারী শাখা ব্যাট উইমেনের সঙ্গে যুক্ত ছিল,” বেনারকে জানান কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইমের উপ–কমিশনার মহিবুল ইসলাম খান।
কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইমের তিনজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে নিলয় সম্পর্কে কথা হয়। তাঁরা বলেন, ইসলামিক স্টেটের উত্থানের পর বাংলাদেশের বেশ কিছু তরুণ সিরিয়া যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। এদের একটি অংশ তুরস্ক হয়ে সিরিয়ায় পাড়ি জমায়। সরকারের তরফ থেকে তুরস্কে যাওয়ার ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করা হলে অন্য অংশটি ব্যর্থ হয়।
ওই সব কর্মকর্তা জানান, যেসব তরুণ সিরিয়ায় যেতে ব্যর্থ হয় তাদের মধ্যে ছিল হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারী নিবরাস ইসলাম, সামেহ মোবাশ্বের, রোহান ইমতিয়াজসহ কল্যাণপুরে পুলিশি অভিযানে নিহত শেহজাদ রউফ অর্ক, আকরাম হোসেন খান নিলয়, তানভির করিমসহ ২০-২৫ জনের একটি দল। আকরাম হোসেন খান নিলয়ও ভারত হয়ে সিরিয়া যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। ব্যর্থ হয়ে দেশে ফিরে আসে।
“নিলয় ২০১৪-১৫ সালে গুলশানের একটি মসজিদে যাতায়াত শুরু করে। রমজান মাসে এতেক্বাফের নামে হলি বেকারির হামলাকারীসহ সমমনা তরুণেরা এই মসজিদে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছিল। শহুরে, উচ্চশিক্ষিত ধনাঢ্য এই তরুণদের নিয়ন্ত্রণ করত তামিম চৌধুরী। এদের একাংশ এখন সিরিয়ায়। অন্যদের মধ্যে পুলিশি অভিযানে কেউ নিহত হয়েছে, কেউবা গ্রেপ্তার হয়েছে,” বেনারকে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা।
তিনি আরও বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে নিলয় ‘ওয়াহাবি’ নামে এক নাইজেরিয় তরুণের কথা জানিয়েছে। সিরিয়ায় যুদ্ধ করতে গিয়ে তার মৃত্যু হয়। গুলশানের ওই মসজিদে বাংলাদেশি তরুণদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মেলামেশা ছিল ওয়াহাবির।
পুলিশ কর্মকর্তার এই তথ্যের সত্যতা স্বীকার করেন ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই কল্যাণপুরে পুলিশি অভিযানে নিহত শেহজাদ রউফ অর্কের বাবা তৌহিদ রউফ। তিনি নিজে মাঝে মাঝে ওই মসজিদ থেকে ছেলেকে আনতে গেছেন বলে জানান বেনারনিউজকে।
“বাড়াবাড়ি রকমের ধর্মকর্ম অর্ক করত না। তবে ঘর ছাড়ার আগে প্রায় বছরখানেক সে গুলশানের একটা মসজিদে যেত। লম্বা সময় সেখানে কাটাত। আমি নিজেও তাকে বেশ কয়েকবার ওখান থেকে আনতে গিয়েছি,” তৌহিদ রউফ বেনারনিউজকে বলেন।
আর ওয়াহাবি সম্পর্কে কথা বলেছেন নিবরাস ইসলামের বাবা নজরুল ইসলাম। হলি আর্টিজানে হামলার পর তিনি এই ছেলেটি সম্পর্কে জানতে পারেন।
“ওয়াহাবি বাংলাদেশ ছাড়ার আগে ধানমন্ডিতে কোনো একটি রেস্তোরাঁয় নিবরাসদের সঙ্গে বসেছিল। এই তথ্য আমরা পরে জানতে পারি। পরে সে সিরিয়ায় মারা যায় বলে শুনেছি,” নজরুল ইসলাম গত রোববার বেনারনিউজকে এই তথ্য জানান।
হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার প্রায় দুই বছর পর নতুন করে নিলয় ও তার সহযোগীদের সম্পর্কে তথ্য পাওয়া প্রসঙ্গে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, “এখন পর্যন্ত নিলয়ের মতো ঠিক কতজন তরুণ জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল, কতজন সিরিয়ায় চলে গেছে, কতজন ধারাবাহিক পুলিশি অভিযানের পরও গোপনে জঙ্গিবাদের চর্চা করে যাচ্ছে সে সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য নেই, থাকলেও তাদের সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।”
“গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য আছে বলেও মনে হয় না। তবে এটাও সত্য যে, হলি আর্টিজানে হামলার পর গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানোর ফলে অনেককে শনাক্ত করা গেছে,” মন্তব্য করেন সাখাওয়াত।
মাদকসেবী থেকে জঙ্গিবাদে নিলয়
তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, নিলয় দেশের শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি মাধ্যম স্কুল স্কলাস্টিকার ছাত্র। ‘ও’ লেভেল পাস করার পর ব্রিটিশ কাউন্সিলের মাধ্যমে ‘এ’ লেভেল পাস করে সে। পরে মালয়েশিয়ায় চলে যায়। এক সময় মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। তবে ২০১২-১৩ সালের দিকে মাদক সেবন ছেড়ে দেয়।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, ২০১৪ সাল থেকে গুলশানের আজাদ মসজিদে তার যাতায়াত শুরু। সে নিজেও কট্টরপন্থায় ঝুঁকে পড়ে, ধীরে ধীরে পুরো পরিবারকে দীক্ষিত করে।
ওই কর্মকর্তা বলছেন, নিলয় বাবা-মা ও বোনসহ সিরিয়া যেতে চেয়েছিল। পাকিস্তান, তুরস্ক ও ইরান দূতাবাস তাকে ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। শেষ পর্যন্ত সে ভারত হয়ে সিরিয়া যাওয়ার চেষ্টা করে। সহযোগী গ্রেপ্তার হওয়ায় দেশে ফিরে আসে নিলয়। সে ভারতে অবস্থান করে নব্য জেএমবির নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে এবং বোমা তৈরি, দলের লোকজনকে অর্থ সরবরাহ, কাকে, কোথায় পাঠাতে হবে—এসব বিষয়ে নির্দেশনা দেয়।
সিরিয়ায় অবস্থানরত তরুণদের কার কার সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে এখনো সে সম্পর্কে পুলিশ নিশ্চিত নয়। তবে জোনায়েদ হাসান খান ও জুন্নুন শিকদারের সঙ্গে নিলয়ের যোগাযোগ থাকতে পারে—এমন ধারণা পেয়েছে পুলিশ।
গত মার্চে গ্রেপ্তারের পর নিলয়কে আদালতে হাজির করা হয়। বিচারকের খাস কামরায় রিমান্ড আবেদনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। ‘কুফর’দের আদালত সে মানে না বলে সরাসরি বিচারককে জানায়। খাস কামরায় উপস্থিত পুলিশের একটি সূত্র বেনারকে এ কথা জানায়।
“খাস কামরায় প্রবেশেও তার অনীহা ছিল। আদালতে তার কয়েকজন স্বজন নানাভাবে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু নিলয় তীব্র অনিচ্ছা নিয়ে শুনানিতে অংশ নেয়,” পুলিশের ওই সূত্রটি জানায়।