হলি আর্টিজান হামলা: হাসনাত করিমের সম্পৃক্ততা মিলছে না
2018.06.29
ঢাকা

হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনায় ২১ জনের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত হলেও জেলে থাকা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিমের জড়িত থাকার তথ্যপ্রমাণ এখন পর্যন্ত মেলেনি। ঘটনার পর থেকে গত দুই বছর বিনা বিচারে জেল খাটছেন হাসনাত, যাঁর জামিনের জন্য ১০ বারেরও বেশি আবেদন করা হয়েছে আদালতে।
২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশান হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছিল বাংলাদেশ ও ব্রিটেনের দ্বৈত নাগরিক হাসনাত করিম ও কানাডিয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাহমিদ হাসিব খানকে। তাহমিদ অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেলেও ছাড়া পাননি হাসনাত।
হাসনাত করিমের পরিবার এখন আদালতে অভিযোগপত্র জমা পড়ার অপেক্ষায়। তাঁর স্ত্রী শারমিনা পারভীন করিম তেমনটিই জানিয়েছেন বেনারনিউজকে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া গত বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেছেন, সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে আদালতে এই মামলার অভিযোগপত্র জমা হবে।
“আমি বার বার বলে আসছি আমার স্বামী নিরপরাধ। কিন্তু অনেক মিডিয়া ও কর্মকর্তা তাঁকে হামলার ঘটনায় সম্পৃক্ত করে নানা কথা লিখেছে। এখন বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে, হাসনাত করিম নির্দোষ,” শারমিনা পারভীন করিম বলেন।
এ পর্যন্ত কমপক্ষে ১০ বার জামিন চেয়েছেন বলে জানান শারমিনা। তিনি জানান, নিম্ন ও উচ্চ—উভয় আদালতেই গেছেন কিন্তু কোনো আদালতই হাসনাতের জামিন আবেদন মঞ্জুর করেনি।
“সবশেষ গত এপ্রিলে জামিনের জন্য আদালতে গিয়েছিলাম, কিন্তু ফলাফল শূন্য,” বলেন শারমিনা।
তাঁর এই কারাবাস পুরো পরিবারটিকে দুর্যোগের মুখে ঠেলে দিয়েছে। হাসনাত নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ছেড়ে বাবা রেজা করিমের ব্যবসায় যুক্ত হয়েছিলেন। হাসনাত কারাগারে আটক থাকার সময়ই তাঁর বাবা মারা যান।
যে কন্যা সন্তানের জন্মদিন উদযাপনে পুরো পরিবার নিয়ে ১ জুলাই রাতে হলি আর্টিজানে গিয়েছিলেন হাসনাত করিম, সেই পরিবারটি পড়েছে নিদারুণ কষ্টে।
শারমিনা পারভীন করিম বলছিলেন, “আমার সন্তানেরা মারাত্মক বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। হাসনাত করিমের মেয়ে হওয়ায় তাদের স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। প্রায় দুবছর ধরে ওরা একরকম ঘরে ছিল। সম্প্রতি গুলশানের একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে দুই মেয়েকে ভর্তি করিয়েছেন।”
এদিকে ঢাকায় ব্রিটিশ দূতাবাস এবং হাসনাত করিমের পারিবারিক সূত্র জানায়, প্রতি দেড়মাস পরপর ব্রিটিশ দূতাবাসের প্রতিনিধি কাশিমপুর কারাগারে গিয়ে হাসনাতের সঙ্গে দেখা করে আসেন। এছাড়া মামলার তারিখ পড়লে খোঁজ নেয় দূতাবাস।
যুক্তরাজ্যের নাগরিক হাসনাত করিমকে ব্রিটিশ সরকার কোনো প্রকার আইনি সহয়তা দিচ্ছে কি না এমন প্রশ্নের ব্যাপারে ঢাকায় অবস্থিত যুক্তরাজ্য দূতাবাসের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, তাঁরা হাসনাত করিমের ব্যাপারে সরকারের কাছে প্রয়োজনীয় সহায়তা পাচ্ছেন। এর বাইরে কোনও মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।
অভিযোগপত্র বিলম্বের কারণ
দুই বছর পরও বিচারপ্রক্রিয়া শুরু না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইমের পক্ষ থেকে দুটি কারণের কথা অনানুষ্ঠানিকভাবে বলা হয়েছে।
একটি কারণ হলো; ঘটনাটি অনেক বড় ও স্পর্শকাতর। তাই পুলিশ অভিযোগপত্রে ফাঁকফোকর রাখতে চায় না।
অপর কারণ হলো হাসনাত করিমের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে না পারা। পুলিশ হাসনাত করিমের সুষ্পষ্ট সম্পৃক্ততা এখন পর্যন্ত খুঁজে পায়নি।
গত ২৫ মার্চ রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে হলি আর্টিজান বেকারিতে নিহত বাংলাদেশি পরিবারগুলোকে সম্মাননা জানায় পুলিশ। ওই অনুষ্ঠানে হামলায় ২১ জন সন্দেহভাজনের কারা কীভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন সে নিয়ে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইমের প্রধান মনিরুল ইসলাম উপস্থাপনা দেন। কিন্তু সেখানেও গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে হাসনাত করিমের সম্পৃক্ততার কথা তিনি উল্লেখ করেননি।
হাসনাত করিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হচ্ছে কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়ার আগে এতে কী আছে তা বলতে পারছি না।”
“আদালত যদি অভিযোগপত্র গ্রহণ করে এবং সেখানে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ না থাকে তাহলে আদালতই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তখন আদালত তাঁকে জামিনও দিতে পারে। চার্জশিট দাখিলের পর বিষয়টি আদালতের এখতিয়ার; সরকারের নয়,” স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন।
“হলি আর্টিজানে হামলার অভিযোগপত্রটি নির্ভুল হওয়া প্রয়োজন,” মন্তব্য করে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “আমি আশা করি পুলিশ নির্মোহ থেকে একটি অভিযোগপত্র দেবে।”
তিনি বলেন, “কারণ এই মামলার অভিযোগপত্রে কী থাকছে সে দিকে শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয়, গোটা বিশ্বের মানুষ তাকিয়ে আছে।”
এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া গত বৃহস্পতিবার বলেছেন, যাদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে কেবলমাত্র তাদের নামই থাকবে অভিযোগপত্রে। নিরপরাধ কেউ যেন বিপদে না পড়েন সে বিষয়টি তাঁরা নিশ্চিত করবেন।
২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। এতে নিহত হন ১৭ জন বিদেশি নাগরিক ও দুজন পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২২ জন। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস ওই হামলার দায় স্বীকার করে। যদিও বাংলাদেশ সরকার দাবি করে আসছে, হামলাকারীরা দেশীয় এবং নব্য জেএমবি ওই হামলা চালিয়েছিল।
শাওন ও সাইফুলের বিষয়ে প্রশ্ন
হামলাকারীদের সঙ্গে অভিযানে নিহত হোলি আর্টিজান বেকারির পিৎজা মেকার সাইফুল চৌকিদার ও পরে নিহত জাকির হোসেন শাওনের ব্যাপারে অভিযোগপত্রে কী বলা হবে, এখন পর্যন্ত সে ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানাচ্ছে পুলিশের সূত্রগুলো।
ছেলেকে জঙ্গি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করায় কষ্টে আছেন হলি বেকারীর পাচক সাইফুল চৌকিদারের স্বজনেরা।
শাওনের বাবা আবদুর সাত্তার বেনারকে বলেন, “ছেলে তো আমার সন্ত্রাসীদের হামলায় মারা গেছে। না পেলাম কোনো ক্ষতিপূরণ, না কেউ বলল যে সে নিরাপরাধ। অন্তত এইটা ঘোষণা দেওয়া হোক যে আমার ছেলে জঙ্গি নয়।”
অভিযোগপত্রে যা থাকছে
অভিযোগপত্র নিয়ে কথা হয়েছে কাউন্টার টেররিজমের পাঁচজন কর্মকর্তার সঙ্গে। তবে তাঁরা স্পর্শকাতরতা বিবেচনায় নাম প্রকাশ করতে চাননি।
কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত কার কী ভূমিকা সে সম্পর্কে থাকছে অভিযোগপত্রে। পরিকল্পনা, অস্ত্র ও অর্থের জোগানদার ও হামলায় সরাসরি সম্পৃক্ত ২১ জনের বিষয়ে অভিযোগপত্রে বলা হবে এতে।
এই ২১ জনের মধ্যে ১৩ অভিযানের দিন ও পরে নিহত হয়েছেন, ছয় জন আটক ও দুইজন পলাতক রয়েছেন।
তবে আইন অনুযায়ী নিহতরা আসামি হবেন না, তবে তাঁদের নাম ও কার্যক্রমের কথা থাকবে অভিযোগপত্রে।