বাংলাদেশে গ্রেপ্তার জঙ্গি সোহেল মাহফুজকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে ভারতের গোয়েন্দারা
2017.07.10
ঢাকা, কলকাতা

চাপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জে গত শুক্রবার ধরা পড়া সোহেল মাহফুজ ওরফে সাহাদাত ওরফে নাসিরুল্লাহকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে ভারতের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার (এনআইএ) একটি প্রতিনিধিদল ঢাকা সফর করবে। দিনক্ষণ ঠিক না হলেও দুই দেশের পুলিশ কর্মকর্তারা এ বিষয়টি বেনারকে নিশ্চিত করেছেন।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম বেনারকে জানিয়েছেন, “বাংলাদেশ ও ভারত দু’দেশের পুলিশই দীর্ঘ সময় ধরে মাহফুজকে খুঁজছিল। ভারতীয় পুলিশ সোহেল মাহফুজকে জিজ্ঞাসাবাদে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।”
অন্যদিকে এনআইএ-র একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেছেন, দুর্ধর্ষ ওই আসামিকে ভারতে এনে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাংলাদেশকে অনুরোধ করা হবে। সেটা সম্ভব না হলে এনআইএ ঢাকায় গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে।
এনআইএ’র আইনজীবী শ্যামল কুমার ঘোষ বেনারকে বলেন, “ভারতের পশ্চিমবঙ্গের খাগড়াগড় বিস্ফোরণের ঘটনায় বিশেষ আদালতে ৩৩ জনের বিরুদ্ধে দেওয়া অভিযোগপত্রে অন্যতম আসামি হিসেবে সোহেল ওরফে সাহাদাত ওরফে নাসিরুল্লাহ’র নাম রয়েছে।”
প্রসঙ্গত ভারত ও বাংলাদেশে উভয় দেশের পুলিশই লম্বা সময় ধরে খুঁজছিল এই সোহেল মাহফুজকে। ভারতে সে পরিচিত ছিল নাসিরুল্লাহ নামে।
ঢাকায় পুলিশ সদরদপ্তরের কাউন্টার টেররিজমের ফোকাল পয়েন্ট মনিরুজ্জামান বেনারকে বলেন, “ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের মিউচুয়্যাল লিগ্যাল অ্যাসিসটেন্স ট্রিটি আছে। এতে করে দু দেশের পুলিশ যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে আসামিদের সঙ্গে কথা বলতে পারে।”
“আমরা ভারতের সঙ্গে রিয়েল টাইম ইনটেলিজেন্স শেয়ার করি। আসামিদের তথ্য বিনিময় করা ও তাদের জেরা করার ব্যাপারে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি রয়েছে। মাস কয়েক আগে আমরা ভারতে গিয়ে সেখানে গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গি মুসাকে জেরা করে এসেছি,” মনিরুজ্জামান বলেন।
গত শুক্রবার দিবাগত রাত পৌনে তিনটার দিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার একটি আমবাগান থেকে সোহেল মাহফুজ তিন সহযোগীসহ গ্রেপ্তার হয়। এরপর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে বলা হয়, “হোলি আর্টিজানে হামলার ঘটনায় সোহেলকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তবে অন্যান্য জঙ্গি হামলার ক্ষেত্রে তার সম্পৃক্ততার তথ্য রয়েছে।”
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সোহেল মাহফুজের সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া জামাল ওরফে মোস্তফা ও হাফিজুর রহমান ওরফে হাসান নব্য জেএমবির সদস্য। তাদের নিয়ে সোহেল উত্তরবঙ্গে জেএমবিকে সংগঠিত করার চেষ্টা করছিল।
সোহেল মাহফুজের বাংলাদেশ–ভারতে যোগাযোগ ও যাতায়াত সম্পর্কে এ সময় বলা হয়, “খাগড়াগড়ে বোমা বিস্ফোরণ মামলার আসামি সোহেল মাহফুজকে ধরিয়ে দিতে বছর তিনেক আগে এনআইএ ১০ লাখ রুপি পুরস্কার ঘোষণা করেছিল।”
“২০০৬ সালে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বিরোধী অভিযান শুরুর পর সে ভারতে পালিয়ে যায়। জেএমবির ভারতীয় শাখার আমির হিসেবে (২০০৯ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত) সে দলটির নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের কাজ করছিল। ২০১৪ সালে খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পর সে আবার বাংলাদেশে চলে আসে। তবে শেষ পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল,” বেনারকে জানান পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইমের উপকমিশনার মোহিবুল ইসলাম।
বাংলাদেশে এসে নব্য জেএমবিতে যোগ দিয়ে সংগঠনের উত্তরাঞ্চলের আমির হিসেবে সে কাজ করছিল বলে জানান ওই পুলিশ কর্মকর্তা।
পশ্চিমবঙ্গে জেএমবির স্থপতি
পশ্চিমবঙ্গের শীর্ষ বাংলা পত্রিকা আনন্দবাজার এর একটি প্রতিবেদনে গত শনিবার দাবি করা হয়েছে, “১৯৯৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের লালগোলা সীমান্ত দিয়ে ঢুকে নাসিরুল্লাহ জেএমবির হয়ে গোপনে প্রচার শুরু করেছিল। তখন পশ্চিমবঙ্গে কেউই জেএমবির নাম জানত না।”
এনআইএ সূত্রের বরাত দিয়ে ওই খবরে বলা হয়েছে, সোহেল মাহফুজ ওরফে নাসিরুল্লাহই পশ্চিমবঙ্গে জেএমবির স্থপতি। তার নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ ও বীরভূম, ঝাড়খন্ডের সাহেবগঞ্জ এবং আসামে জেএমবির সাংগঠনিক ঘাঁটিও তৈরি করা হয়েছিল।
বাংলাদেশে নিষিদ্ধ জেএমবি ভারতের কয়েকটি রাজ্যে কীভাবে জিহাদি কার্যক্রম চালাচ্ছিল, তা খাগড়াগড় বিস্ফোরণের তদন্তে প্রথম প্রকাশ পায়। ২০১৪ সালের ২ অক্টোবর খাগড়াগড়ের একটি দোতলা বাড়িতে গোপনে বোমা তৈরির সময়ে বিস্ফোরণে দুই জঙ্গি শাকিল গাজি ও করিম শেখ নিহত হয়। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে দুই শিশু সহ শাকিল গাজির স্ত্রী রাজিয়া বিবি এবং আব্দুল হাকিমের স্ত্রী আলিমা বিবি নামে দুই নারীকে গ্রেপ্তার করে।
তদন্তে বেরিয়ে আসে, বিস্ফোরণে নিহত দুজনই ছিল বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত জেএমবির সদস্য। এদের মধ্যে নিহত শাকিল গাজি ছিল সোহেল মাহফুজ ওরফে নাসিরুল্লার ঘনিষ্ঠ।
এনআইএ ওই মামলায় পাঁচ দফায় মোট ৩৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে। এদের মধ্যে ২৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। নাসিরুল্লাহ ধরা পড়ায় এখনো পলাতক রয়েছে ৭ জন। আগামী ১৩ জুলাই মামলার নতুন করে বিচার শুরু হওয়ার দিন ধার্য রয়েছে।
হোলি আর্টিজানে সম্পৃক্ততা
“হোলি আর্টিজানে হামলার পরিকল্পনা বৈঠকে সোহেল মাহফুজ নিজেই উপস্থিত ছিল। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডীয় নাগরিকদের মধ্যে ওই ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িত প্রত্যেকেই সোহেলের নাম বলেছে,” জানান মনিরুল।
“পরিকল্পনা বৈঠকে উপস্থিত থাকা ছাড়াও, নব্য জেএমবির অস্ত্র ও গোলাবারুদের চালান সে দিত বলে আমরা তথ্য পাচ্ছি,” মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন। তিনি আরও বলেন, সোহেল মাহফুজ এখন সাত দিনের রিমান্ডে। আশা করা হচ্ছে হোলি আর্টিজানে হামলায় আর কারও সম্পৃক্ততা ছিল কি না এবং পলাতক বাকি চার আসামির কে কোথায় আছে সে সম্পর্কে তার কাছ থেকে তথ্য জানা যাবে।
কে এই হাতকাটা মাহফুজ?
সোহেল মাহফুজের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালি উপজেলার সাদীপুরে। সাদীপুরের ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য আবু বক্কার জানান, সে বহু বছর ধরে এলাকাছাড়া।
“সোহেল মাহফুজের ডাক নাম হাসান। ওর বাবা রেজাউর রহমান এলাকায় জমিজমা মাপজোখের কাজ করেন। বোমায় হাসানের হাত উড়ে যাওয়ার খবর আমরা শুনেছি। বেশ কয়েক মাস আগে ওর ভাই হাফিজকে র্যাব গ্রেপ্তার করে,” আবু বক্কার বেনারকে বলেন।
সোহেল মাহফুজ নব্য জেএমবির মজলিশে শুরার সদস্য। তবে জঙ্গিবাদে তার হাতেখড়ি পাবনা জেলা স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময়। ২০০৪ সালে রাজশাহীর বাগমারার হামিরকুৎসায় সিদ্দিকুর রহমান বাংলা ভাই এর জাগ্রত মুসলিম জনতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে ‘সর্বহারা’ নিধনে যুক্ত হয়েছিল এই সোহেল। পরে ককটেল ছোড়ার সময় তার হাত উড়ে যায়। তখন থেকেই তার নাম হয় হাতকাটা মাহফুজ।
মনিরুল ইসলাম বলেন, “তবে বরাবরই তার অবস্থান ছিল সীমান্তবর্তী এলাকায়। হাত উড়ে যাওয়ায় সহজেই চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় সে একরকম আড়ালেই ছিল। সে মূলত ধরা পড়ার ভয়ে খুব একটা বের হতো না। অস্ত্র ও গোলাবারুদ কেনাকাটা ও বানানোর কাজে যুক্ত থাকত।”
“নব্য জেএমবির নেতারা তার সঙ্গে এসে দেখা করেছে। এমনকি তামীম চৌধুরী পুলিশি অভিযানে নিহত হওয়ার পর মাঈনুল ওরফে মুসা তার সঙ্গে দেখা করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ কেনার জন্য টাকা দিয়ে আসে। পুলিশি অভিযানে নিহত হওয়ার আগেও সোহেল মাহফুজের সঙ্গে মাঈনুল ওরফে মুসার কথা হয়,” জানান মনিরুল।
পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ পুলিশ ৪১ জন জঙ্গির একটি তালিকা ভারতীয় পুলিশকে হস্তান্তর করে। সেখানে সোহেল মাহফুজের ছবি দেখে পুলিশ তাকে নাসিরুল্লাহ বলে শণাক্ত করে। ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ আসামি হিসেবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তার ছবি প্রচার করে তাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে।
সোহেল মাহফুজকে গ্রেপ্তারের পর গত শুক্রবার রাজশাহী রেঞ্জের উপ মহাপরিদর্শক এম খুরশীদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “সোহেল মাহফুজকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে ২০০৬ সাল থেকে। গত ১১ বছর একবারও সে ধরা পড়েনি। তাকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে উত্তরাঞ্চলে নব্য জেএমবির যে তৎপরতা ছিল তা নিয়ন্ত্রণে এলো।”