হলি আর্টিজান হামলা: আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল
2018.07.23
ঢাকা

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী জঙ্গি হামলার দু বছরের মাথায় বুধবার আটজনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে পুলিশ।
ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজানে ২০১৬ সালের ১ জুলাই নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবির হামলায় ১৭ জন বিদেশি নাগরিক ও দুই পুলিশ সদস্যসহ নিহত হন ২২ জন। এই নব্য জেএমবি আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের মতাদর্শ অনুসরণ করে থাকে।
পুলিশি তদন্তে ব্রিটিশ নাগরিক হাসনাত করিম ও হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁর দুই কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।
“আজ (সোমবার) আমরা আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছি। এই হামলায় আমরা নব্য জেএমবির ২১ জনের সম্পৃক্ততা পেয়েছি,” ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রন্সন্যাশনাল ক্রাইমের প্রধান মনিরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, যে ২১ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে, তাঁদের ১৩ জন পুলিশি অভিযানে নিহত হয়েছেন বা আত্মঘাতী হয়েছেন। জীবিত আছেন ৮ জন।
“পাঁচ সন্ত্রাসী কমান্ডো অভিযানে নিহত হয়েছে। বাকি আটজন জঙ্গিবাদবিরোধী পুলিশি অভিযানে নিহত হয়েছে,” তিনি বলেন।
মনিরুল ইসলাম জানান, যে আটজনকে আসামি করা হয়েছে তাদের ছয়জন পুলিশি জিম্মায় আছে, দুজন এখন পর্যন্ত পলাতক।
হলি আর্টিজানের হামলার ধরন প্রসঙ্গে মনিরুল বলেন, এটি নব্য জেএমবির একটি পূর্বপরিকল্পিত হামলা।
“আমরা হাসনাত করিম এবং হলি আর্টিজানের দুই কর্মচারী সাইফুল ইসলাম চৌকিদার ও জাকির হোসেন শাওনের কোনো সম্পৃক্ততা পাইনি,” মনিরুল ইসলাম বলেন।
ব্রিটিশ নাগরিক হাসনাত করিম ১ জুলাই স্ত্রী-সন্তানসহ হলি আর্টিজান ক্যাফেতে তাঁদের এক সন্তানের জন্মদিন উদ্যাপন করতে গিয়েছিলেন।
পরদিন সকালে কমান্ডোরা অভিযান শুরু করলে জঙ্গিরা হাসনাত করিম, তাঁর স্ত্রী ও দুই মেয়েকে মুক্তি দেয়। পুলিশ পরে সন্দেহভাজন হিসেবে হাসনাত করিমকে গ্রেপ্তার করে।
কোনো অভিযোগ ছাড়াই গত দুই বছর ধরে হাসনাত করিম কারাগারে আছেন।
ক্যাফের ভেতরে পাওয়া যায় সাইফুল ইসলাম চৌকিদারের মৃতদেহ, আর আহত অবস্থায় উদ্ধারের পর হাসপাতালে মারা যান শাওন।
আসামি আটজন
মনিরুল ইসলাম বলেন, সন্ত্রাস বিরোধী আইনে দায়ের হওয়া মামলায় যে আটজনকে আসামি করা হয়েছে, তাঁরা হলেন, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম ইসলাম ওরফে রাশেদ ওরফে র্যাশ, সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজ, হাদীসুর রহমান সাগর, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, মামুনুর রশিদ রিপন ও শরীফুল ইসলাম খালিদ।
এই আটজনের ছয়জন কারাগারে থাকলেও, পলাতক আছে রিপন ও খালিদ।
সম্পৃক্ত আরও ১৩
কমান্ডো অভিযানে নিহত পাঁচ হামলাকারী হলেন; রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, মীর সামিহ মোবাশ্বের, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ওরফে বিকাশ।
মনিরুল ইসলাম বলেন, এই হামলার ‘মাস্টারমাইন্ড’ ছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডীয় নাগরিক তামিম চৌধুরী।
১ জুলাই পরবর্তীতে বিভিন্ন পুলিশি অভিযানে নিহত হন আটজন। তাঁরা হলেন; তামিম চৌধুরী, সরোয়ার জাহান ওরফে আব্দুর রহমান, তানভীর কাদেরী ওরফে জামসেদ, নূরুল ইসলাম মারজান, বাশারুজ্জামান চকোলেট, মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান, মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম ও রায়হান কবির ওরফে তারেক।
মনিরুল ইসলাম বলেন, নিহত ১৩ জন বিচার প্রক্রিয়া থেকে বাদ গেলেও তিনি আশা করেন, বাকি আটজনের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
আদালতে শুনানি শুরু ২৬ জুলাই
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারনিউজকে বলেন, আগামী ২৬ জুলাই অভিযোগপত্র গ্রহণের শুনানি হতে পারে। তিনি বলেন, আদালত এই ‘নির্ভুল এবং পক্ষপাতহীন অভিযোগপত্র গ্রহণ করবেন বলে আশা করেন।
হাসনাত করিমের স্ত্রী শারমিনা পারভিন সোমবার বেনারনিউজকে বলেন, ২৬ জুলাই আদালত তাঁর নির্দোষ স্বামীকে হয়তো মুক্তি দেবেন।
“আলহামদুলিল্লাহ। তদন্তে আমার স্বামী দায়মুক্ত হয়েছেন,” তিনি বলেন। শারমিনা সোমবারই স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে কাশিমপুর কারাগারে গিয়েছিলেন।
“ও রেডিওর খবরে জানতে পারে যে তদন্তে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছে। সে আমাকে দ্রুত বাসায় গিয়ে অন্য গণমাধ্যমগুলো কী বলছে সে সম্পর্কে খোঁজ নিতে বলে,” শারমিন বলেন।
‘আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ছিল না’
মনিরুল ইসলাম বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তারা বিদেশি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে হলি আর্টিজানে হামলাকারীদের কোনো যোগাযোগের খবর পায়নি। তিনি বলেন, জঙ্গিদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে একটি জঙ্গি রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করা এবং এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর কাছ থেকে প্রযুক্তি, অস্ত্র ও অর্থ আদায় করা।
“পুলিশ যদি সামনের সারির নেতা যেমন তামিম চৌধুরী অথবা সারওয়ার জাহান বা নুরুল ইসলাম মারজানকে গ্রেপ্তার করতে পারত তাহলে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস, আল কায়েদা বা হিযবুত তাহরিরের সঙ্গে নব্য জেএমবির কোনো সম্পর্ক আছে কি না সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারত। মৃত্যুর আগে তামিম চৌধুরী তার সমস্ত যন্ত্রপাতি ও দলিল দস্তাবেজ ধ্বংস করে ফেলে,” মনিরুল ইসলাম বলেন।
কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইমের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, নব্য জেএমবি অমুসলিম বিদেশিদের ওপর হামলার পরিকল্পনা করেছিল পাঁচ-ছয় মাস আগে।
“যেসব জায়গায় বিদেশিদের ঘনঘন যাতায়াত আছে, এমন রেস্তোরাঁগুলো তারা অনেকবার রেকি করেছে। হামলার দু–তিন দিন আগে হলি আর্টিজানকে তারা বেছে নেয়। কারণ হলি আর্টিজানের নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই এবং হামলা চালিয়ে খুব সহজে পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। পাশাপাশি এই রেস্তোরাঁয় প্রচুর বিদেশির যাতায়াত ছিল,” তিনি বলেন।