সিরিজ বোমা হামলার এক যুগ: জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে থাকলেও নির্মূল হয়নি

প্রাপ্তি রহমান
2017.08.17
ঢাকা
রাজধানীর পান্থপথে হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে জঙ্গি বিরোধী অভিযানে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ও সোয়াট সদস্যরা। রাজধানীর পান্থপথে হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে জঙ্গি বিরোধী অভিযানে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ও সোয়াট সদস্যরা। আগস্ট ১৫, ২০১৭।
নিউজরুম ফটো

২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩টি জেলায় একযোগে বোমা হামলার পর এক যুগ ধরে ধারাবাহিক অভিযানে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলেও কখনো নাম পরিবর্তন করে, কখনো লক্ষ্যবস্তু পরিবর্তন করে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো তাদের অস্তিত্বের জানান দিয়ে গেছে, এখনো যাচ্ছে।

“জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো খণ্ড–বিখণ্ড হয়ে গেছে। একযোগে বড় হামলা করার সামর্থ্য আর তাদের নেই,” ১৫ আগস্ট এর জাতীয় শোক দিবসকে সামনে রেখে বলেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইমের প্রধান মনিরুল ইসলাম।

ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের সঙ্গে তিনি কথা বলার মাত্র ১২ ঘণ্টার মাথায় রাজধানীর পান্থপথের হোটেলে বোমা বিস্ফোরণে সন্দেহভাজন এক জঙ্গি সাইফুল নিহত হন।

এ প্রসঙ্গে বুধবার ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া মন্তব্য করেন, “জঙ্গি সাইফুল ইসলাম একা আসেনি। পান্থপথে বোমা বিস্ফোরণের সময় তার অন্য সহযোগীরাও আশপাশে ছিল।”

সাইফুলের ঘটনার সূত্র ধরে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান বেনারকে বলেন, “পুলিশ বলছে সাইফুল খুব সম্প্রতি নব্য জেএমবিতে নাম লিখিয়েছে। তার মানে রিক্রুটমেন্ট থেমে নেই। তার মানে আরও হামলার আশঙ্কা আছে।”

“আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে আপাত স্বস্তির যে একটা জায়গা তৈরি হয়েছিল, তা আবারও ক্ষুণ্ন হলো ১৫ আগস্টের ঘটনায়,” বলেন নূর খান।

তবে জঙ্গিবাদকে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবেই দেখেন মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, “জঙ্গিবাদের সমস্যাটা রাজনৈতিক। দেশি ও বিদেশি অপরাজনীতির ‘বাই প্রোডাক্ট’ হলো জঙ্গিবাদ। এটা দমন করা গেছে, এখন লক্ষ্য নির্মূল করা।”

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বেনারকে বলেন, “রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে। এটা জঙ্গিবাদ দমনের প্রথম শর্ত। দ্বিতীয়ত, তরুণেরা জঙ্গিবাদে কেন জড়াচ্ছে, সেটার কারণ অনুসন্ধান করে সামাজিক উদ্যোগ নিতে হবে।”

সিরিজ বোমা হামলার এক যুগ

২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা ১১ টার মধ্যে দেশের ৬৩টি জেলার প্রায় পাঁচশ টি জায়গায় একযোগে বোমা হামলা চালায় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। এতে দুজন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছিলেন।

১৯৯৮ সালে শায়খ আবদুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত এই দলটির একটি অংশই পরে গুলশানের হোলি আর্টিজানে হামলা চালায়।

২০০৫ সালের ওই ঘটনায় আদালতে দায়ের হয় ১৬০টি মামলা। মামলার রায়ে শীর্ষ জঙ্গি নেতা শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইসহ ৩৫ জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

পুলিশের হিসেবে, এসব মামলার মধ্যে ৫৩ টি মামলার বিচার শেষ হয়নি। শেষ হওয়া ১০৭টি মামলায় মোট ১২৮ জনের যাবজ্জীবন এবং ১১৮ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে।

“২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট যে ঘটনাটি ঘটে, তার ঠিক এক মাস আগে জুলাই মাসে ব্রিটেনে একাধিক জায়গায় হামলা হয়। সেখান থেকে দলটি এ দেশে হামলা চালানোর অনুপ্রেরণা পায়,” মনিরুল ইসলাম বলেন।

তাঁর মতে, সময়ের পরিক্রমায় দলের একটি অংশ এখন সিরিয়া ও ইরাক ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের মতাদর্শ অনুসরণ করছে।

‘আল্লাহর জমিনে আল্লাহর আইন কায়েম করতে ক্বিতাল বা সশস্ত্র সংগ্রাম’ এর উদ্দেশ্যে গড়া দলটি প্রথম ধাপে, কথিত আল্লাহর আইন বাস্তবায়নে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিচারক, দ্বিতীয় ধাপে ভিন্ন মতাবলম্বী, অমুসলিম ও বিদেশি এবং শেষ ধাপে বড় জনসমাবেশে হামলার উদ্দেশ্যে কাজ করছে বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।

পুলিশি তদন্তে জানা গেছে, জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ এখন দুটি অংশে বিভক্ত। একটি পুরনো, অন্যটি নতুন। পুরোনো জেএমবির নেতৃত্ব দিচ্ছেন সালাউদ্দীন সালেহীন। এ মুহূর্তে নতুন জেএমবির নেতৃত্বে কে আছেন সে সম্পর্কে পুলিশ পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। নব্য জেএমবিতে পুরোনো জেএমবির সদস্যদের সম্পৃক্ততা ছিল, কিন্তু এ মুহূর্তে তারা এক হওয়ার চেষ্টা করছে কি না তা জানা যায়নি।

মনিরুল বলেন, পুরোনো জেএমবির সদস্য ও গুলশানের হোলি আর্টিজান হামলার আসামি সোহেল মাহফুজ, জাহাঙ্গীর ওরফে রাজীব গান্ধী তাঁদের জানিয়েছেন, পুরোনো ও নতুন অংশের মধ্যে আস্থাহীনতা ও অবিশ্বাস এখন চরমে। সে কারণে তাদের পক্ষে এখন একযোগে হামলা চালানো সম্ভব নয়।

সম্প্রতি সাহম আল হিন্দ নামে জঙ্গিগোষ্ঠীটির একটি মুখপত্রে সালাউদ্দীন সালেহীনের একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। সেখানে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, তাঁরা শেষ হয়ে যাননি। বাংলাদেশের সীমানার বাইরে নতুন নতুন জায়গায় তাদের কার্যক্রমের বিস্তার ঘটেছে।

সালেহীন বলেন, ১৭ আগস্টের হামলা বাংলাদেশে ‘জিহাদের’ পথকে খুলে দেয়। এখান থেকেই শুরু এবং তারা ‘সশস্ত্র সংগ্রাম’ চালিয়ে যাবেন।

প্রসঙ্গত ২০১৪ সালের অক্টোবরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার একটি আস্তানায় বোমা তৈরির সময় বিস্ফোরণে দুই জঙ্গি নিহত হয়।

ওই ঘটনায় অভিযুক্ত অন্যদের সাথে বাংলাদেশি নাগরিক সালাউদ্দীন সালেহীনকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ৫ লাখ রুপি পুরস্কার ঘোষণা করেছিল ভারতের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনআইএ। তবে তাঁর বিরুদ্ধে প্রমাণের অভাবে এখনো অভিযোগপত্র দিতে পারেনি বলে গত জুলাইতে বেনারকে জানিয়েছেন এনআইএ-র এক তদন্ত কর্মকর্তা।

আলোচনার বাইরে থাকা জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো

জঙ্গিবাদ নিয়ে যারা কাজ করছেন, তাঁরা বলছেন জেএমবির নতুন-পুরনো অংশ নিয়ে আলোচনার বাইরে যে বিষয়টি থেকে যাচ্ছে তা হলো নিষিদ্ধ ঘোষিত আনসার আল ইসলাম। এই দলটি দেশের ব্লগার হত্যাকাণ্ডগুলোর দায় স্বীকার করেছে। এখন পর্যন্ত ২০১৩ সালে নিহত আহমেদ রাজীব হায়দার ছাড়া কোনো ব্লগার হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি।

হিযবুত তাহরীর প্রথম শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত তরুণদের দলে টানে। হরকাতুল জিহাদের প্রধানের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। কিন্তু দলটি কি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে? ওই দলের বাকি নেতা ও সদস্যরা কোথায় সবকিছুরই খোঁজ রাখা জরুরি বলেও মনে করছেন মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।