তেরো বছরে বিচার হয়নি ২০০৪’র ২১ আগস্ট হামলার

কামরান রেজা চৌধুরী
2017.08.21
ঢাকা
রায়ের পর আদালতে নেওয়ার পথে ২০০০ সালে শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টার সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা। রায়ের পর আদালতে নেওয়ার পথে ২০০০ সালে শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টার সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা। আগস্ট ২০, ২০১৭।
নিউজরুম ফটো

তেরো বছর পার হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সন্ত্রাস-বিরোধী জনসভায় গ্রেনেড হামলা মামলার বিচারিক কাজ শেষ হয়নি। কর্তব্যরত পুলিশের উপস্থিতিতে প্রকাশ্য দিবালোকে জঙ্গি গোষ্ঠী হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামের (হুজি) চালানো ওই হামলায় সেদিন শেখ হাসিনা অল্পের জন্য বেঁচে যান।

ওই ঘটনায় মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভি রহমানসহ আওয়ামী লীগের ২২ নেতা-কর্মী নিহত ও আহত হন কয়েকশ মানুষ। দিনটি স্মরণে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গতকাল সোমবার বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে।

এদিকে ১৭ বছর আগে ২০০০ সালে শেখ হাসিনাকে প্রথম হত্যাচেষ্টা হয়েছিল। গত রোববার সেই মামলায় ১০ জনের ফাঁসি ও ১৩ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডের রায় দিয়েছে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২।

দণ্ডপ্রাপ্ত সবাই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের (হুজি-বি) নেতা-কর্মী বলে জানান রাষ্ট্র পক্ষের আইনজীবী সামশুল হক বাদল।

শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হুজির চারটি হামলার মধ্যে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় অফিসের সামনে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের হামলাটি ছিল সবচেয়ে নৃশংস। এটি ছিল আওয়ামী লীগ নেত্রীর উপর চালানো সর্বশেষ হামলা। প্রথম হত্যাচেষ্টার সময় তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আর শেষ হামলার সময় ক্ষমতায় ছিল বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট।

ওই হামলায় নিহতদের একজন মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়নের চানপট্টি গ্রামের লিটন।

তাঁর বাবা আইয়ুব আলী মুন্সি বেনারকে বলেন, “আমার ছেলে যুবলীগ করত। শেখ হাসিনার মিটিং শেষ করে বাড়ি ফেরার কথা ছিল। কিন্তু আমার পোলারে মাইরা ফালাইল। আমার পোলার কী দোষ আছিল?”

“তেরো বছরেও বিচার হয়নি। জানি না আমরা বিচার পামু কি না,” আক্ষেপ এই বাবার।

তবে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সৈয়দ রেজাউর রহমান সোমবার বেনারকে বলেন, “খুব তাড়াতাড়ি মামলার রায় হবে আশা করি।”

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বেনারকে বলেন, “২০০৪ সালে বিএনপি সরকার ২১ আগস্ট হামলাকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার জন্য জজ মিয়া নামক এক ব্যক্তিকে আক্রমণকারী হিসেবে উপস্থাপন করে। তখন হুজির সংশ্লিষ্টতা সামনে আসেনি। তবে আমরা সকল জঙ্গির বিচার করব।”

মামলাটিতে এখন আসামী পক্ষের সাফাই সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে বলে জানান রেজাউর রহমান।

মামলার নথি অনুযায়ী, আসামি পক্ষের ২০ জন নির্দোষ দাবি করে আদালতে বক্তব্য দেন। ইতিমধ্যে ১২ জনের সাফাই সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে।

আইন অনুযায়ী, সাফাই সাক্ষ্য গ্রহণের পর বাদী ও বিবাদী পক্ষ যুক্তি উপস্থাপন করবেন। যুক্তি-তর্ক শেষ হলেই রায় হবে।

২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে বিএনপি ক্ষমতা থেকে চলে গেলে, ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনরায় তদন্ত শুরু করে। সিআইডির তদন্তে বেরিয়ে আসে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে হুজি ২১ আগস্ট হামলা চালিয়েছিল।

সিআইডি ২০০৮ সালের জুনে বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তাঁর ভাই তাজউদ্দিন, হুজি নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেয়।

হামলায় ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড পাকিস্তান থেকে এসেছিল বলে তদন্তে বেরিয়ে আসে। ২০০৮ সালে এই ঘটনা সংক্রান্ত দুটি হত্যা ও বিস্ফোরক মামলার বিচার শুরু হয়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মামলাটির অধিকতর তদন্ত শুরু করে। দ্বিতীয় দফা পুনঃতদন্ত অনুযায়ী ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি।

এতে বিএনপি নেতা তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, হারিছ চৌধুরী, জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদসহ ৩০ জনকে নতুন করে আসামি করা হয়।

মোট ৫২ আসামির মধ্যে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ার তারেক রহমানসহ ১৮ জনকে পলাতক দেখিয়ে বিচার শুরু হয়। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে বিএনপি সরকারের আমলে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর ও র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখায় কর্মরত কিছু সেনা কর্মকর্তা সাক্ষ্য দেন।

বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ার তারেক রহমান বর্তমানে লন্ডন অবস্থান করছেন। হুজি নেতা মুফতি হান্নান ও জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসি হওয়ায় অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

১৭ বছর পর প্রথম হত্যাচেষ্টার বিচার

হুজি শেখ হাসিনাকে প্রথম হত্যার পরিকল্পনা করে ২০০০ সালের জুলাই মাসের ২০ তারিখে। হুজি নেতা মুফতি হান্নানের নেতৃত্বে জঙ্গিরা শেখ হাসিনার নির্বাচনী এলাকা কোটালীপাড়ায় ৭৬ কেজি বোমা পুঁতে রাখে। তবে সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

১৭ বছর পর রোববার ওই মামলার ঘোষিত রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলো: ওয়াসিম আখতার ওরফে তারেক হোসেন ওরফে মারফত আলী, রাশেদ ড্রাইভার ওরফে আবুল কালাম ওরফে রাশেদুজ্জামান ওরফে শিপন, মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, আবু বক্কর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, হাফেজ মো. ইয়াহিয়া, আবদুর রউফ ওরফে মুফতি আবদুর রউফ ওরফে আ. রাজ্জাক ওরফে আবু ওমর এবং পলাতক ইউসুফ ওরফে মোহসাব মোড়ল, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, মুফতি শফিকুর রহমান ও মুফতি আবদুল হাই।

কারাবন্দী মেহেদী হাসান ওরফে আবদুল ওয়াদুদ ওরফে গাজীকে যাবজ্জীবন দণ্ড দিয়েছে আদালত।

আর ১৪ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কারাগারে থাকা আনিসুল ইসলাম আনিস ও মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান এবং পলাতক সারোয়ার হোসেন মিয়া।

অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পেয়েছেন কারাবন্দী আরিফ হাসান সুমন ওরফে আবদুর রাজ্জাক, মাহমুদ আজহার, মাওলানা সাব্বির এবং পলাতক কামাল উদ্দিন সাকের, মুন্সী ইব্রাহিম, মো. শাহনেওয়াজ ওরফে মো. আজিজুল হক,শেখ মো. এনামুল হক, মো. লোকমান, মিজানুর রহমান ও আবুল হোসেন ওরফে খোকন।

আসামি পক্ষের আইনজীবী ফারুক আহমেদ বেনারকে বলেন, “আমরা রায়ে সন্তুষ্ট নই। আমরা এর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাব। এই রায় নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে।”

মামলার রেকর্ড অনুযায়ী, হুজি শেখ হাসিনাকে মুসলমান মনে করে না। তাঁদের মতে, শেখ হাসিনা ভারত-পন্থী।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।