আত্মঘাতি বিস্ফোরণে জঙ্গি পরিবারের সদস্যদের হতাহতের আশংকা

পুলক ঘটক
2017.09.05
ঢাকা
র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ অভিযানস্থল পরিদর্শন করেন। র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ (ডান থেকে তৃতীয়) অভিযানস্থল পরিদর্শন করেন। সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১৭।
বেনারনিউজ

টানা ২৪ ঘণ্টার অভিযানে রাজধানীর মিরপুরের একটি বাড়িতে অবস্থানরত সন্দেহভাজন জঙ্গিদের সর্বশেষ অবস্থা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে আত্মঘাতি বিস্ফোরণে ওই বাড়িতে অবস্থানরত নারী ও শিশুসহ কমপক্ষে সাতজনের প্রাণহানির আশংকা করা হচ্ছে।

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) ধারণা করছে, ওই বাড়িতে দুর্ধর্ষ জঙ্গি আবদুল্লাহ তাঁর দুই স্ত্রী, দুই শিশু সন্তান ও দুজন সহযোগীসহ অবস্থান করছিল।

অবরুদ্ধ জঙ্গিরা আত্মসমর্পণে রাজি হয়েছে বলে মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে দাবি করেছিল র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। কিন্তু এর প্রায় তিন ঘণ্টা পর রাত ১০টার দিকে পরপর তিনটি বড় ধরনের বিস্ফোরণে ওই বাড়ি থেকে আগুন ও ধোঁয়া বের হয়।

র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বেনারকে বলেন, “ভেতরে থাকা জঙ্গিরা বিস্ফোরণ ঘটানোর ফলে ভবনে আগুন লাগে। দমকল বাহিনী আগুন নেভায়।”

“ওই বাড়িতে তল্লাশি অভিযান চালানোর পর বলা যাবে সেখানে কতজন হতাহত হয়েছে,” জানান মাহমুদ। তিনি বলেন, ওই ঘটনায় র‍্যাবের চারজন সদস্য আহত হয়েছেন।

গত সোমবার মধ্যরাত থেকে রাজধানীর মিরপুরে একটি বাড়িতে এই অভিযান শুরু হয়। মঙ্গলবার সকালে ছয়তলা ভবনের ২৪টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ২৩টির ৬৫ জন বাসিন্দাকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়। ওই বাড়ির বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে।

র‌্যাব সদর দপ্তরের কর্মকর্তা (মিডিয়া) মেজর মিজান মেহেদি বেনারকে জানান, “সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে সোমবার রাত ১টার দিকে দারুস সালাম রোডের ওই বাড়িটিকে ঘিরে ফেলা হয়। এর পরপরই ওই বাড়ির ভেতর থেকে জঙ্গি সদস্যরা কয়েকটি বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়।”

তিনি জানান, “বোমা বিস্ফোরণ ঘটানোর পর পরই র‌্যাব সদস্যরা নিশ্চিত হয় যে, বাড়িতে জঙ্গিরা অবস্থান করছে।”

ঘটনার সূত্র টাঙ্গাইল থেকে

সকাল ১১টার দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, গত সোমবার সন্ধ্যায় টাঙ্গাইলে একটি অভিযানে দুই ভাইকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। যাদের একজন ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।

তিনি জানান, সোমবার রাত ১১টার দিকে সেই অভিযানের ফলোআপ হিসেবে দারুস সালাম রোডের বাড়িটিতে অভিযান শুরু করা হয়। এখানে আবদুল্লাহ নামের একজন দুর্ধর্ষ জঙ্গি রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

র‌্যাব মহাপরিচালকের বক্তব্য অনুযায়ী, এই এলাকায় ১০/১২ বছর ধরে বসবাস করা আবুদল্লাহ ২০০৫ সাল থেকে জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত। তিনি আইপিএস ও ইউপিএস এর ব্যবসা, ফ্রিজ মেরামত ও কবুতর ব্যবসা করেন। এসব ব্যবসার আড়ালেই প্রচুর বিস্ফোরক জমা করেছেন এই ‘দুর্ধর্ষ জঙ্গি’।

তিনি জানান, আইপিএস তৈরির জন্য বিপুল পরিমাণ অ্যাসিডের প্রয়োজন। সেই সুযোগ নিয়ে এ জঙ্গি তার আবাসস্থলে প্রচুর অ্যাসিড, পেট্রলসহ অন্যান্য দাহ্য রাসায়নিক জমা করেছে। সোমবার ভোর চারটা থেকে তাঁর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। সে ৫০টির বেশি আইইডি থাকার কথা জানায়। এ ছাড়া তার কাছে বিভিন্ন ধরনের দাহ্য পদার্থ এবং একটি পিস্তল রয়েছে বলে জানায়।

আবদুল্লাহ’র বোনের আত্মসমর্পণ

মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, “জঙ্গি আস্তানা থেকে আবদুল্লাহর বোন ইতিমধ্যে আত্মসমর্পণ করেছে। তাকে দিয়েই আবদুল্লাহকে আত্মসমর্পণ করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।”

র‌্যাব মহাপরিচালক বলেন, “আবদুল্লাহর সঙ্গে ফোনে বারবার যোগাযোগ করে আত্মসমর্পণ করতে বলা হলে সে সময় চেয়েছে। যেহেতু ভেতরে দুটি শিশু রয়েছে, আমরা তাদের জীবিত উদ্ধারের জন্য সময় দিয়েছি।”

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা

মিরপুরের দারুস সালাম থানা এলাকার প্রতিটি প্রবেশ পথে নিরাপত্তা চৌকি বসিয়েছে র‌্যাব। বেড়ি বাঁধ সংলগ্ন ভাঙা দেয়াল এলাকায় ওই বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছালে দেখা যায় বাড়িটির ছাদেও র‌্যাব সদস্যরা অবস্থান নিয়েছে।

“কমল প্রভা” নামের ওই বাড়িটির মালিক হাবিবুল্লাহ বাহার আজাদকে র‌্যাব হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, হাবিবুল্লাহ বাহার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তিনি একসময় বিটিসিএল এ চাকরি করতেন এবং সেখানে সিবিএ নেতা ছিলেন।

সন্দেহভাজন জঙ্গি আব্দুল্লাহ’র বোন মেহেরুন্নেসা মানসিক প্রতিবন্ধী। বাড়িটি ঘিরে ফেলার পর তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন। তাকেও র‌্যাব হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।

ভবনের বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১৭।
ভবনের বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১৭।
নিউজরুম ফটো
র‌্যাবের সূত্র এবং স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গত ১৫ বছর ধরে ওই বাসায় বাস করছে আবদুল্লাহ। তার এক ভাইয়ের নাম খোকা। সেও সন্দেহভাজন জঙ্গি। ছয় তলার ওই বাড়িতে আবদুল্লাহ তিন তলার বাসিন্দা।

ভবনের একাধিক বাসিন্দা বেনারকে জানান, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জঙ্গি তৎপরতা সম্পর্কে তাঁদের কোনো ধারণা ছিল না।

বাড়িটিতে আটকা পড়েছিলেন গুলশান আরা বেগম এবং তার স্বামীর নাম নুরুল হক। গুলশান আরা বেনারকে জানান, “রাত একটার দিকে বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। আমরা ভয় পেয়ে যাই। জানালা দিয়ে দেখি র‌্যাব বাড়িটি ঘিরে রেখেছে। দরজা জানালা বন্ধ করে ভেতরেই ছিলাম।”

তিনি বলেন, “ভোর ছয়টার দিকে র‌্যাব আমাদের বের করে আনে। সামনে একটি নির্মাণাধীন বাড়ির নিচতলায় আমাদের সবাইকে জড়ো করে। সেখানে প্রত্যেককে জিজ্ঞাসাবাদ করে।”

“প্রত্যেকের কাছে জানতে চেয়েছে এই পরিবারকে চেনেন কিনা। দুপুর ১২টার দিকে আমাদের ছেড়ে দেয়। আমাদের বলে আত্মীয় স্বজনের সাথে যোগাযোগ করে নিরাপদ স্থানে চলে যান,” জানান গুলশান।

ভবনের বাসিন্দা মোবারক হোসেন জানালেন, “রাতে অনেক শব্দ এবং আগুনের গোলা দেখতে পেয়ে আমি অবস্থা দেখার জন্য বেরিয়ে এসেছিলাম। র‌্যাব বাসার ভেতর ঢুকতে বলায় আবারও ঘরে ঢুকে পড়ি।”

র‍্যাবের মুখপাত্র মাহমুদ বলেন, ‘সন্ধ্যায় আব্দুল্লাহ আত্মসমর্পণ করবে বলে আমাদের কাছে রাত আটটা পর্যন্ত সময় চেয়েছিল। আমরা সময় দিয়েছি। সাড়ে আটটার দিকে বললেন তিনি নামাজ পড়ার সময় চান, আমরা দিলাম। এরপর সে আমাদের কাছে আরো আধাঘণ্টা সময় চায়। আমরা আরও ধৈর্য্য ধরলাম।’

গতকাল সকালে মাজার রোড থেকে বর্ধন বাড়ি এলাকায় যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করে দেয় র‍্যাব। র‍্যাব কর্মকর্তারা কিছুক্ষণ পরপর ঘটনা সম্পর্কে সংবাদকর্মীদের জানাচ্ছিলেন। আশপাশের এলাকায় মানুষের চলাচল এবং দোকানপাট—সবকিছুই বন্ধ করে দেওয়া হয়।

মঙ্গলবার রাত একটায় এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত অভিযান অব্যহত ছিল। র‍্যাব সদস্যরা বাড়িটি ঘিরে রাখে। বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে ভবনের ভেতর কেউ বেঁচে নেই বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক র‍্যারে দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন। তবে কারা এবং কতজন হতাহত হয়েছে—সে সম্পর্কে বুধবার র‍্যাব বিস্তারিত জানাবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।