মিরপুরের জঙ্গি আস্তানায় দুই শিশুসহ সাত লাশ

পুলক ঘটক
2017.09.06
ঢাকা
ঢাকার মিরপুরে জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চলাকালে দমকল বাহিনীর গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে র‍্যাবের সশস্ত্র পাহারা। ঢাকার মিরপুরে জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চলাকালে দমকল বাহিনীর গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে র‍্যাবের সশস্ত্র পাহারা। সেপ্টেম্বর ০৬, ২০১৭।
নিউজরুম ফটো

ঢাকার মিরপুরে ঘিরে রাখা সেই ‘জঙ্গি আস্তানা’য় বিস্ফোরণের ঘটনার পর তল্লাশি চালিয়ে সাতজনের লাশ পাওয়া গেছে। তবে সেগুলো এতটাই বিকৃত যে কোনটি নারী বা কোনটি পুরুষের লাশ তা নির্ধারণ করতে পারেনি র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র‌্যাব)।

লাশগুলো সন্দেহভাজন জেএমবি সদস্য আবদুল্লাহ, তার দুই স্ত্রী নাসরিন ও ফাতেমা, দুই ছেলে ওমর ও ওসামা, যাদের বয়স তিন থেকে নয় বছর এবং নাম না জানা আবদুল্লাহ’র দুই কর্মচারীর বলে ধারণা র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজির আহমেদের।

বুধবার দুপুরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “জঙ্গি আব্দুল্লা যে বাসায় ছিল, সেখানে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সাতটি স্কাল দেখে আমরা মনে করছি সেখানে সাত জনের লাশ রয়েছে।”

মাজার রোডের পাশে বর্ধনবাড়ি ভাঙা ওয়ালের গলির ‘কমল প্রভা’ নামের বাড়িটি সোমবার মধ্যরাত থেকে ঘিরে রেখেছিল র‌্যাব।

ছয় তলা ওই ভবনের পঞ্চম তলায় আবদুল্লাহ নামে একজন জঙ্গি ও তার দুই স্ত্রী, দুই সন্তান ও দুই সহযোগীসহ মোট সাতজন অবস্থান করছিল বলে এর আগে জানিয়েছেন বেনজীর আহমেদ।

তিনি জানান, “আবদুল্লাহ একজন ‘দুর্ধর্ষ জঙ্গি’। সে ২০০৫ সাল থেকে জঙ্গিবাদে জড়িত।”

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বুধবার সকালে বেনারকে বলেন, “এখন পর্যন্ত জঙ্গি আস্তানার একটি রুম তল্লাশি করা গেছে। সেখানে তিনটি লাশ পাওয়া গেছে। লাশ তিনটি দগ্ধ হওয়ায় নারী না পুরুষের তা শনাক্ত করা যায়নি।”

“মনে হচ্ছে গতকাল রাতের বিস্ফোরণে তারা মারা গেছে। আমাদের অভিযান চলছে,” জানান তিনি।

র‌্যাব সদর দপ্তরের কর্মকর্তা (মিডিয়া) মেজর মিজান মেহেদি বেনারকে জানান, “সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে সোমবার রাত ১টার দিকে দারুস সালাম রোডের ওই বাড়িটিকে ঘিরে ফেলা হয়।”

ওই বাড়ির বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল। মঙ্গলবার সকালে ভবনের ২৪টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ২৩টির ৬৫ জন বাসিন্দাকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়।

বিস্ফোরণে ভবনটির পঞ্চম তলায় জঙ্গিদের ফ্ল্যাটে আগুন ধরে যায়। সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১৭।
বিস্ফোরণে ভবনটির পঞ্চম তলায় জঙ্গিদের ফ্ল্যাটে আগুন ধরে যায়। সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১৭।
নিউজরুম ফটো

বিস্ফোরণের পর আগুন

মঙ্গলবার সারা দিন যোগাযোগ করে আবদুল্লাহকে আত্মসমর্পণে রাজি করানোর চেষ্টা চালায় র‌্যাব। সন্ধ্যায় র‌্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আবদুল্লাহ রাজি হয়েছে এবং রাত সাড়ে ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে আত্মসমর্পণ করবে বলে জানিয়েছে।

কিন্তু জঙ্গিরা র‌্যাব সদস্যদের আরও তিন ঘণ্টা অপেক্ষায় রাখে। রাত পৌনে ১০টার দিকে ভবনটিতে পর পর চার দফা বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা। থেমে থেমে শোনা যায় গুলির শব্দ।

বিস্ফোরণে পঞ্চম তলায় জঙ্গিদের ফ্ল্যাটে আগুন ধরে যায়। সেখান থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলি উঠতে দেখা যায়। এ সময় এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

বিস্ফোরণের কিছু সময় পর মুফতি মাহমুদ খান সাংবাদিকদের বলেন, “ভেতরে যারা ছিল তারাই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।”

বুধবার সকালে নতুন করে অভিযান শুরুর পর পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক ও র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

বুধবার দুপুর পৌনে ১২টার দিকেও ওই ভবনের কাছে গুলির শব্দ পাওয়া গেছে। সাংবাদিকদের ভবনের সামনে যেতে না দেওয়ায় কারা এই গুলি করেছে তা নিশ্চিত করা যায়নি।

সারোয়ার-তামিম গ্রুপের সদস্য আবদুল্লাহ

জঙ্গি আব্দুল্লাহ নেতৃত্ব পর্যায়ের একজন ছিলেন বলে মনে করছে র‌্যাব। তবে তিনি কোন জঙ্গি গ্রুপের সদস্য সকাল পর্যন্ত তা নিশ্চিত করতে না পারলেও বিকেলে র‌্যাব মহাপরিচালক সাংবাদিকদের বলেন, “আব্দুল্লাহ জেএমবির সারোয়ার-তামিম গ্রুপের আল-আনসার সদস্য ছিলেন।”

তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, জেএমবির এই অংশটির প্রধান সারোয়ার জাহান, কানাডীয় নাগরিক তামিম চৌধুরী, অংশটির আরেক নেতা সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজসহ অনেকেই আব্দুল্লাহর বাড়িতে থেকেছেন।

“সারোয়ার-তামিম অংশটি ভেঙে যাওয়ার আগে পুরোনো অংশের এক শুরার সদস্য, তাঁর নাম আমি বলতে চাই না, তিনি গ্রেপ্তার হওয়ার পর আব্দুল্লাহর বিষয়ে জানিয়েছিলেন,” বেনজির জানান।

র‌্যাব-৪-এর সহকারী পুলিশ সুপার আবদুল আউয়াল বেনারকে জানান, জঙ্গি আবদুল্লাহর গ্রামের বাড়ি চুয়াডাঙ্গায়। তাঁর বাবা ইউসুফ আলী অনেক আগেই মারা গেছেন।”

র‌্যাব মহাপরিচালক জানান, “২০০৫ সাল থেকে জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত আবদুল্লাহ আইপিএস ও ইউপিএস এর ব্যবসা, ফ্রিজ মেরামত ও কবুতর ব্যবসা করতেন। এসব ব্যবসার আড়ালেই ওই বাসায় প্রচুর বিস্ফোরক জমা করেন এই দুর্ধর্ষ জঙ্গি।”

এলাকাবাসীও বলছেন, তিনি আইপিএস ও ফ্রিজ মেরামতসহ বাসাবাড়িতে মিস্ত্রির কাজ করতেন। পাশাপাশি ওই বাড়ির ছাদে কবুতর পালতেন।

এলাকার পরিচিত মুখ

র‌্যাব যাকে আব্দুল্লাহ বলছে তাকে এলাকাবাসীর অনেকে টিটু নামে চেনেন। টিটু প্রায় ১৫ বছর ওই বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। এলাকাবাসী বলেছেন, ওই ভবনে খোকা নামে টিটুর এক ছোট ভাইও থাকত।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক এলাকাবাসী বেনারকে বলেন, “টিটু নামের ওই ব্যক্তিকে আমরা চিনি। রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা এড়িয়ে চললেও প্রায়ই চায়ের দোকানে বসতেন তিনি। কিন্তু তিনি যে ভেতরে-ভেতরে জঙ্গিবাদে জড়িত তা একটুও বোঝা যায়নি।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।