নিউ ইয়র্কে বোমা হামলা: আকায়েদ উল্লা দোষী সাব্যস্ত
2018.11.06
ওয়াশিংটন ডিসি

গত ডিসেম্বরে নিউ ইয়র্কে বোমা হামলাকারী বাংলাদেশি আকায়েদ উল্লাহকে মঙ্গলবার সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালত।
এ প্রসঙ্গে এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল জেফ্রি এস. বারমেন বলেন, “উল্লার ভয়ানক আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল আশপাশের যত বেশি সম্ভব নিরপরাধ মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত ও আতঙ্কিত করা।”
“আজ উল্লা দোষী সাব্যস্ত হয়েছে, এতে তার সম্ভাব্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে, এবং তার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছে,” বলেন জেফ্রি।
গত বছর ১১ ডিসেম্বর সকালে নিউ ইয়র্কের টাইম স্কয়ারের কাছে পোর্ট অথরিটি বাস টার্মিনালের পাতালপথে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ ঘটাতে গিয়ে হাতেনাতে গ্রেপ্তার হন ২৭ বছরের আকায়েদ উল্লাহ। এই বোমা হামলায় আকায়েদ ও অন্য তিনজন আহত হন।
এ ঘটনায় নিউ ইয়র্কের পুলিশ আকায়েদের বিরুদ্ধে অপরাধমূলকভাবে অস্ত্র রাখা, সন্ত্রাসবাদী কাজ সমর্থন এবং সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকি তৈরির অভিযোগ দায়ের করে।
নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটান ফেডারেল আদালতে আকায়েদের মামলার শুনানি শেষ হয় সোমবার। মঙ্গলবার আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করে। নিয়ম অনুযায়ী আকায়েদের শাস্তি ঘোষণা করা হবে আরো কয়েকদিন পরে।
শুনানির শেষ দিন আকয়েদ সন্ত্রাসী নয় বলে আদালতে দাবি করেন তার আইনজীবী।
“সে মরতে চেয়েছিল। সে শুধুই তার নিজের জীবন ধ্বংস করতে চেয়েছিল,” আদালতে বলেন আকায়েদের আইনজীবী অ্যামি গ্যালিকিও, জানায় বার্তাসংস্থা এপি।
গ্যালিকিও বলেন, “সেটি আত্মঘাতী বোমা হামলা নয়। সেটি সন্ত্রাসী আক্রমণও নয়।”
তবে আকায়েদ তার কাজের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের আতঙ্কিত করতে চেয়েছিল বলে আদালতে যুক্তি উপস্থাপন করেন এ মামলায় সরকার পক্ষের আইনজীবী সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল জর্জ টার্নার।
একই সাথে তিনি জানান, আকায়েদ অনলাইন মাধ্যমে ইসলামিক স্টেট বা আইএস এর অনুসারী ছিল এবং সে আইএস এর একজন ‘লোন উলফ’ বা বিচ্ছিন্ন যোদ্ধা হিসেবে ঘটনাটি ঘটিয়েছে।
যদিও আকায়েদের আইনজীবী এই বক্তব্যের বিরোধীতা করে বলেন, “ওটা মূলত একজন উন্নাসিক মানুষের উন্নাসিক কাজ ছিল। ওটি কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন যোদ্ধার আক্রমণ ছিল না,” জানায় বার্তাসংস্থা এপি।
‘আমি এটা ইসলামিক স্টেট এর জন্য করেছি’
ঘটনার পর নিজের বোমায় আহত আকায়েদকে গ্রেপ্তার করে চিকিৎসার জন্য স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে সে হামলা সম্পর্কে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় বলে ঘটনার পর নিউইয়র্ক সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে জাননো হয়।
এতে বলা হয়, “আমি এটা ইসলামিক স্টেট এর জন্য করেছি,” বলে তদন্তকারীদের কাছে স্বীকার করেছে আকায়েদ।
এছাড়া ঘটনার পর সংবাদ সম্মেলন করে নিউইয়র্ক সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্ট এর ভারপ্রাপ্ত অ্যাটর্নি জেনারেল জুন কিম জানান, আকায়েদ ২০১৪ সালের দিকে আইসিসের বিভিন্ন প্রচারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জঙ্গিবাদে দীক্ষা নিয়ে এই আক্রমণে উদ্বুদ্ধ হবার কথাও তদন্তকারীদের কাছে স্বীকার করেছে।
ঘটনার এক বছর আগে থেকেই আকায়েদ বোমা বানানোর কৌশল সম্পর্কে গবেষণা করছিল জানিয়ে জুন কিম জানান, “সে হামলার জন্য কয়েক সপ্তাহ ধরে পরিকল্পনা করছিল। দুই থেকে তিন সপ্তাহ আগে থেকে বোমা তৈরির উপকরণ সংগ্রহ শুরু করে এবং আক্রমণের সপ্তাহখানেক আগে সে বোমাটি তৈরি করে।”
আকায়েদ নিজের বাড়িতেই বোমাটি বানিয়েছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানায় অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস।
ব্রুকলিনে আকায়েদের বাসা তল্লাশি করে পুলিশ বোমায় ব্যবহৃত উপকরণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিভিন্ন উপকরণ উদ্ধার করেছে বলেও জানান তিনি।
এছাড়া আকায়েদের পাসপোর্ট এবং তাঁর নিজের হাতে লেখা একটা নোটও তাঁর বাড়ি তল্লাশিকালে পুলিশ উদ্ধার করে বলে জানান তিনি।
এতে লেখা ছিল “নিজের কৃতকর্মেই আমেরিকা ধ্বংস হবে” (অল আমেরিকা, ডাই ইন ইওর রেজ), বলেন কিম।
বোমা হামলার দিন ভোরবেলা আকায়েদ তাঁর ফেসবুকে ‘ট্রাম্প তুমি তোমার জাতিকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছ,’ বলে এক পোস্ট প্রকাশ করে বলেও জানানো হয় অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের বিজ্ঞপ্তিতে।
বাংলাদেশে সন্ত্রাসে সম্পৃক্ততার প্রমাণ নেই
আকায়েদের বাবার সাথে সন্দ্বীপে একই স্কুলের পড়ালেখা করা হাজারিবাগের ব্যবসায়ী আবু ছায়েদ মিয়াজী গত ডিসেম্বরে বেনারকে বলেন, “আকায়েদের পরিবারের কেউ কখনো মৌলবাদী কোনো সংগঠনে যুক্ত ছিল না। আকায়েদের বাবা মনেপ্রাণে সন্ত্রাসকে ঘৃণা করতেন।”
আকায়েদ ঢাকার জিগাতলার কাকলি স্কুল থেকে ২০০৪ সালে এসএসসি ও পরে মুন্সী আবদুর রউফ রাইফেলস কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে। এর পর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএতে ভর্তি হয়েছিল।
বিবিএ পড়ার মাঝখানে ২০১১ সালে সে সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্র চলে যায় বলে বেনারকে জানিয়েছিলেন আকায়েদের ঢাকার প্রতিবেশীরা।
যুক্তরাষ্ট্রে যাবার আগে আকায়েদ “আর দশটা সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের মতোই ছিল,” বলে গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম।
“বাংলাদেশে থাকার সময় তার কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার প্রমাণ আমরা পাইনি,” জানান মনিরুল ইসলাম।
গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে আকায়েদ উল্লা বাংলাদেশে গিয়েছিল। সেখানে তার স্ত্রী ও একটি শিশু সন্তান রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আকায়েদের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস জুই বেনারকে বলেন, “আমার স্বামী সেপ্টেম্বরে আসার পর অধিকাংশ সময়ই বাসায় থেকেছে। বাচ্চার সঙ্গে ছিল। সে নামাজ পড়ত ঠিক, কিন্তু আমার কখনো মনে হয়নি সে এরকম (জঙ্গিবাদী) কিছু করতে পারে।”
“আমি চাই বিষটি তদন্ত করা হোক। সে যদি দোষী হয় তাহলে তাকে শাস্তি দেওয়া হোক,” গত বছর বেনারকে বলেছিলেন জুই।