জঙ্গিবাদের অভিযোগে ইংরেজি মাধ্যম একটি স্কুলের কার্যক্রম বন্ধ
2017.11.08
ঢাকা

প্রায় হাজার দেড়েক শিক্ষার্থীর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়েই জঙ্গিবাদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ইংরেজি মাধ্যমের লেকহেড গ্রামার স্কুল বুধবার থেকে বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। সরকারি সিদ্ধান্তে ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশান ও ধানমন্ডিতে অবস্থিত স্কুলের শাখা দুটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. ইলিয়াস মেহেদি ধানমন্ডি শাখাটি বন্ধ করে দেন।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “স্কুলটির প্রশাসনিক কর্মকর্তার কাছে বিদ্যালয়ের সমস্ত কিছু জিম্মায় দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগামীকাল বুধবার থেকে আর এই কোনো স্কুলের কার্যক্রম চালানো হবে না বলে লিখিতভাবে বলা হয়েছে।”
আরেক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শরিফুল আলম গুলশানের শাখাটি বন্ধ করে দেন।
তবে এ বিষয়ে অভিভাবকদের কিছু না জানানোয় বুধবার সকালেও কিছু অভিভাবক তাদের সন্তান নিয়ে লেকহেড স্কুলের ধানমন্ডি শাখায় আসেন বলে বেনারকে জানান স্কুলের নিরাপত্তাকর্মী শাহজাহান। তিনি বলেন, মঙ্গলবার পর্যন্ত সেখানে ক্লাস হয়েছে।
তিনি জানান, স্কুলের কোনো শিক্ষক বা কর্মকর্তা বুধবার স্কুলে আসেননি। তিনি একাই স্কুল পাহারা দিচ্ছেন।
লেকহেড স্কুলের ফোন নম্বরটিও আজ থেকে বন্ধ রয়েছে।
একজন অভিভাবক বেনারকে বলেন, “যারা জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত তাদের ধরুক। স্কুল বন্ধ করা কোনো ভালো সিদ্ধান্ত নয়। আমাদের সন্তানরা এখন কোথায় পড়বে?”
শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত রোববার এক চিঠিতে এই স্কুলটি বন্ধের ব্যবস্থা নিতে ঢাকা জেলা প্রশাসককে অনুরোধ জানায়।
চিঠিতে বলা হয়, “ঢাকা মহানগরের ধানমন্ডি ও গুলশানে অবস্থিত লেকহেড গ্রামার স্কুলটি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন না থাকায় এবং ধর্মীয় উগ্রবাদে অনুপ্রেরণা, উগ্রবাদী সংগঠন সৃষ্টি, জঙ্গি কার্যক্রমে পৃষ্ঠপোষকতাসহ জাতীয় ও স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রতিষ্ঠানটির সব কার্যক্রম বন্ধের ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হলো।”
জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িত থাকার অভিযোগে এ বছর ৬ ফেব্রুয়ারি স্কুলটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় তদন্ত শেষে স্কুলটি বন্ধ করার নির্দেশ দেয়।
সোমবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সালমা জাহানের সই করা এক চিঠিতে ঢাকার জেলা প্রশাসককে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দিতে বলা হয়।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র মাসুদুর রহমান বুধবার বেনারকে বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ঢাকা জেলা প্রশাসন লেকহেড গ্রামার স্কুল বন্ধ করেছে। পুলিশ এখনো পর্যন্ত স্কুলের কোনো শিক্ষক বা কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেনি।
জঙ্গিবাদ সম্পৃক্ততা
গত বছর সেপ্টেম্বর দুই তারিখে নব্য জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) এর জঙ্গি মেজর জাহিদুল ইসলাম পুলিশের গুলিতে ঢাকার রূপনগর এলাকায় নিহত হওয়ার পর লেকহেড স্কুলের জঙ্গি সম্পৃক্ততা নিয়ে গণমাধ্যমে খবর বের হলে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তদন্তে নামে।
মেজর জাহিদুল ইসলাম সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে লেকহেড গ্রামার স্কুলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি নব্য জেএমবি জঙ্গিদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিতেন।
“মেজর জাহিদ (জাহিদুল ইসলাম) এক সময় এখানে চাকরি করতেন। আগে যারা এখানে চাকরি করতেন তারা এখন আর কেউ নেই,” বলেন স্কুলের নিরাপত্তাকর্মী শাহজাহান।
তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, লেকহেড গ্রামার স্কুলটি ২০০০ সালে ধানমন্ডি ৬/এ সড়কের একটি বাড়িতে শুরু হয়।
স্কুলটির প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন জেনিফার আহমেদ যিনি নিজে হিযবুত তাহরীরের একজন সদস্য ছিলেন। জেনিফার বাংলাদেশে হিযবুত তাহরীরের অন্যতম প্রধান নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গোলাম মাওলার স্ত্রী।
২০০৯ সালে হিযবুত তাহরীর নিষিদ্ধ হওয়ার পর এই স্কুল প্রথম আলোচনায় আসে। পরে জেনিফার লন্ডন চলে যান।
এরপর স্কুলটি পরিচালনার দায়িত্ব নেন হারুন ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের মালিক হারুন অর রশিদ ও তাঁর ছেলে রেজওয়ান হারুন। রেজওয়ান হারুন গত ১২মে লন্ডন থেকে ঢাকায় আসেন। এরপর থেকে তিনি নিখোঁজ রয়েছেন।
তদন্তকারী কর্মকর্তারা মতে, লেকহেড গ্রামার স্কুলে শিক্ষক ছিলেন রাজীব করিম, তাঁর ভাই তেহজিব করিম, তেহজিবের স্ত্রী সিরাত করিম এবং তাঁদের সহযোগী মাইনুদ্দিন শরীফ।
রাজীব করিম যুক্তরাষ্ট্রগামী ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ফ্লাইট উড়িয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে ২০১০ সালে যুক্তরাজ্যে গ্রেপ্তার ও পরবর্তীতে সেখানে ৩০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।
২০১০ সালে ইয়মেনে আল-কায়েদা বিরোধী অভিযানে গ্রেপ্তার হয়ে সেখানে আট মাস কারাগারে বন্দী ছিলেন তেহজিব করিম।
এ ছাড়া ২০১৪ সালে পরিবারসহ সিরিয়ায় চলে যাওয়া মাইনুদ্দিনের ভাই রেজওয়ান শরিফও লেকহেডের শিক্ষক ছিলেন।
লেকহেড স্কুলের শিক্ষার্থী আয়মান আলী খান আজ বুধবার স্কুলের ফেসবুক পেজে লিখেছেন, “শান্তি ও ভালোবাসা ছাড়া লেকহেড আমাকে আর কিছু শেখায় নি। আমাকে শেখানো হয়েছে হাসতে হবে, বড়দের সালাম দিতে হবে, বাবা-মাকে শ্রদ্ধা করতে হবে, ছোটদের ভালোবাসতে হবে, আর নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করতে হবে।”
আয়মান বলেন, কোনো একটি পুকুরে কিছু খারাপ মাছ থাকলে পুরো পুকুরটি ধ্বংস করা ঠিক নয়।