সামরিক উচ্চাভিলাষী রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী সামরিক সদস্য গণতন্ত্রের জন্য বিপদ: আদালত
2017.05.19
ঢাকা

সামরিক উচ্চাভিলাষী রাজনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী সামরিক বাহিনীর সদস্যদের গণতন্ত্রের দুই ধরনের বিপদ হিসেবে আখ্যায়িত করে এই বিপদ থেকে মুক্ত হতে সাংবিধানিক গ্যারান্টি থাকা উচিত বলে মনে করে দেশের সর্বোচ্চ আদালত।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই) এর অর্থ আদায় অবৈধ ঘোষণার পূর্ণাঙ্গ রায়ে এই মন্তব্য করে আদালত। রায়টি গত বুধবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
রায়ে সামরিক বাহিনীর ওপর বেসামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য ছয় দফা দিক নির্দেশনা দিয়েছে আদালত। পাশাপাশি, এতে বলা হয়, সংবিধান বা আইন অনুযায়ী গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কর আদায়ের কোনো অধিকার নেই।
প্রসঙ্গত, ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার সময়ে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই ৪০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রায় ১ হাজার ২২৯ কোটি টাকা আদায় করে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিয়েছিল। পরবর্তীতে এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে ১১টি রিট করা হয়। ওই ১১টি রিটের বিপরীতে মোট অর্থের পরিমাণ ৬১৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।
এই আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ১৬ মার্চ এভাবে অর্থ নেওয়া অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বিভাগ। রায়ে আবেদনকারীদের ৬১৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
প্রধান বিচারপতির এস কে সিনহার লেখা পূর্ণাঙ্গ সেই রায়টি বুধবার প্রকাশ পেয়েছে।
যুগান্তকারী রায়
এ রায়কে যুগান্তকারী উল্লেখ করে এর পর্যবেক্ষণগুলো সামরিক বাহিনী ও রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য দিক নির্দেশনা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
“সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক সরকারের অধীনেই থাকতে হয়। এটাই নিয়ম। আমরা অতীতে এর ব্যত্যয় দেখেছি, যা সমর্থন করা যায় না,” বেনারকে বলেন মেজর জেনারেল (অব:) আব্দুর রশিদ।
“এটা একটা সুপ্রিম কোর্টের একটি সাহসী, সঠিক এবং যুগান্তকারী রায়। বেসামরিক বিষয়ে সেনাবাহিনীর নাক গলানো উচিত নয়—এ রায়ে তা আবারও স্পষ্ট হলো,” বেনারকে বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম।
রাজনৈতিক দল দ্বারা সেনাবাহিনী ব্যবহার হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বা টিকে থাকার জন্য সামরিক বাহিনীর মধ্যে রাজনৈতিক লিপ্সা জাগিয়ে তোলেন। যা খুবই দুঃখজনক।”
তবে এই সমাজবিজ্ঞানীর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ।
তিনি বেনারকে বলেন, “সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার যৌক্তিকতা নেই। সুযোগও নেই। সামরিক বাহিনী দেশের গৌরব। এই প্রতিষ্ঠান তার ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য সব সময় রাজনীতির ঊর্ধ্বে থেকে কাজ করে গেছে। অতীতে যদি কোনো ভুল-ত্রুটি হয়েও থাকে, আশা করি ভবিষ্যতে তারা সেগুলো এড়িয়ে চলবে।”
“ওয়ান ইলেভেনের পর যে সরকার, তার পরিচয় হয়েছিল সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সংবিধানে এর কোনো অস্তিত্ব নেই। এটা যারা করেছে তাদেরই দায় নিতে হবে,” বলেন জেনারেল রশিদ।
তবে সমগ্র সামরিক বাহিনী নয়, সেসময় কিছু বিপথে যাওয়া কর্মকর্তা এসব ভুল করেছে বলে মনে করেন মাহবুব উল আলম হানিফ।
ছয় দফা নির্দেশনা
গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা এবং সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু সাধারণ নীতিমালা থাকা উচিত মন্তব্য করে রায়ে ৬টি বিষয় তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, রাষ্ট্র এবং সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যকার মৌলিক সম্পর্ক সংজ্ঞায়িত করে একটি স্পষ্ট আইনি এবং সাংবিধানিক কাঠামো থাকতে হবে।
প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তা–সংক্রান্ত আইন প্রণয়নে, প্রতিরক্ষানীতিতে এবং বাজেট অনুমোদনে সংসদের একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা থাকবে।
সামরিক বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের নেতৃত্ব জনপ্রশাসনের একটি বেসামরিক অঙ্গের মাধ্যমে সরকারের কাছে জবাবদিহি করবে। সাধারণভাবে একটি মন্ত্রণালয় কিংবা প্রতিরক্ষা বিভাগের এই দায়িত্ব থাকবে।
বেসামরিক কর্তৃপক্ষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি সুপ্রশিক্ষিত এবং অভিজ্ঞ সামরিক বাহিনী থাকবে। রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার নীতি এবং সশস্ত্র বাহিনীর নির্দলীয় থাকাসহ বেসামরিক নিয়ন্ত্রণ নীতিসমূহের প্রতি তাদের থাকবে অবিচল আস্থা।
একটি উন্নত নাগরিক সমাজ থাকবে এবং জাতির সামরিক বাহিনীর ভূমিকা ও তার লক্ষ্য সম্পর্কে দেশের জনগণের মধ্যে একটি মতৈক্য থাকবে।
এবং প্রতিরক্ষা বিভাগে একটি যুক্তিসংগত বেসরকারি উপস্থিতি থাকবে।
দায় এড়াতে পারে না ডিজিএফআই
ডিজিএফআইয়ের পক্ষ থেকে আদালতকে বলা হয়েছিল, ডিজিএফআইয়ের একজন কর্মকর্তা অর্থ আদায় করেছেন এবং অর্থ আদায় করতে গিয়ে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। সে কারণে ডিজিএফআই সংগঠনগতভাবে কোনো দায়দায়িত্ব নেবে না।
তবে আদালত বলেছে, বাহিনীটি তার দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারে না। কারণ, পে-অর্ডারের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের পরে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা তাঁর কার্যক্রমের বিষয়ে সংস্থার প্রধানকে অবহিত করেছিলেন।
আদালতে প্রদত্ত বর্ণনা অনুযায়ী ডিজিএফআইয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকা একটি নির্দিষ্ট অফিসে ব্যবসায়ীদের উপস্থিত হতে বাধ্য করা হয়। তাঁদের একত্রে দিনের পর দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসিয়ে রাখা হয়।
রায়ে বলা হয়েছে, বিশিষ্ট এবং ধনাঢ্য ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার, অন্তরীণ রাখা এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে দিনের পর দিন নির্যাতন করা হয়েছে। সংস্থাটির পক্ষে এমন সব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যা অবশ্যই তিরস্কারযোগ্য।
ডিজিএফআই একটি স্বাধীন সংগঠন এবং তাদের কার্যক্রম নির্বাহী বিভাগ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তারা নির্বাহী বিভাগের মতো কাজ করতে পারে না।
এটা হলো সরকারের কাজ। অথচ সরকার নীরব দর্শক থেকেছে। একটি গোয়েন্দা বিভাগের অমানবিক কার্যক্রমকে সহায়তা করে বাংলাদেশ ব্যাংক তার রীতিনীতি লঙ্ঘন এবং সীমা অতিক্রম করেছে।
তবে রায়ে ঐতিহ্যগত প্রতিরক্ষার ভূমিকা ছাড়াও দুর্যোগ মোকাবিলা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদানের জন্য সামরিক বাহিনীর প্রশংসা করা হয়। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাকে হত্যা ও দেশে সামরিক আইন জারি করার ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা বাহিনীর ভূমিকার নিন্দা করা হয়েছে। এগুলোকে বাহিনীর অন্ধকার দিক হিসেবে আখ্যায়িত করেছে আদালত।