নরসিংদীতে র‌্যাবের ‘জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযান’ নিয়ে প্রশ্ন

প্রাপ্তি রহমান
2017.05.22
ঢাকা
ঘিরে রাখা বাড়িটি থেকে পাঁচজনকে এভাবে একে একে বের করে আনা হয়। ঘিরে রাখা বাড়িটি থেকে পাঁচজনকে এভাবে একে একে বের করে আনা হয়। মে ২১, ২০১৭।
স্টার মেইল

নরসিংদীর উত্তর গাবতলীতে র‌্যাবের জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযান নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে নানা প্রশ্ন উঠেছে। প্রায় ২২ ঘণ্টা অভিযান শেষে র‌্যাব যে পাঁচজনকে আটক করে তাঁদের চারজনই ছাত্র এবং এলাকাবাসীর পরিচিত।

যে পাঁচজনকে ঘটনাস্থল থেকে র‌্যাব আটক করে তাঁর হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর পরীক্ষার্থী সালাউদ্দীন, নরসিংদী সরকারি কলেজের গণিত বিভাগের ছাত্র আবু জাফর মিয়া, একই কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র বাসিকুল ইসলাম, জামিয়া কাশেমিয়া মাদ্রাসার দশম শ্রেণির ছাত্র মাসুদুর রহমান ও সাবেক ছাত্র মশিউর রহমান।

ওই মাদ্রাসা থেকে কামিল পাশ করে মশিউর উত্তর গাবতলির ওই বাসায় থেকে চাকরির চেষ্টা করছিলেন। দশম শ্রেণির ছাত্র আবু জাফর তাঁর কাছে পড়তে গিয়েছিল।

তবে অভিযান শেষে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, সিলেটের আতিয়া মহলে থাকা জঙ্গিদের সঙ্গে নরসিংদির এই বাড়িতে অবস্থানরত কারও কারও যোগাযোগ থাকতে পারে। এই তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব অভিযান করেছে।

শনিবার বিকেল থেকে উত্তর গাবতলীর নির্মাণাধীন যে বাড়িতে র‌্যাব অভিযান শুরু করে সে বাড়ির মালিক মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী মাঈনউদ্দীন। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জামিয়া কাশেমিয়া কামিল মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে উত্তর গাবতলিতে একটা ছোটখাট শহর গড়ে উঠেছে।

দিনভর এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যায়। জানা যায়, আটককৃতদের তিনজন উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত ওই মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছেন। তাই স্থানীয় লোকজন তাঁদের ভালোভাবে চেনেন। তাঁরা তাঁদের কিন্ডারগার্টেন স্কুল ও মাদ্রাসা পড়ুয়া সন্তানদের টিউশনের দায়িত্বও এই তরুণদের দিয়েছিলেন।

তবে অভিযানে বাড়িটি থেকে তেমন কিছু উদ্ধার হয়নি বলে জানান র‌্যাব কর্মকর্তা মুফতি মাহমুদ খান।

অভিযান শেষে রোববার দুপুরের দিকে বাড়িতে তালা মেরে র‌্যাব ঘটনাস্থল ছেড়ে যায়। পরে তালা খুলে ভেতরে ঢুকে কয়েকটি প্লাস্টিকের বস্তায় কাপড়চোপড় ও অল্প কিছু তৈজসপত্র পায় র‍্যাব।

রাত ৯টার দিকে র‌্যাব আটককৃত তিনজনকে ছেড়ে দেয়। তবে সালাউদ্দিন ও আবু জাফর মিয়ার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা হয়।

দুটি ফেসবুক স্ট্যাটাস ও অভিযানের পূর্বাপর

এদিকে শনিবার বাইরে থেকে আটকে ফেলার পরই আবু জাফর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে প্রাণে বাঁচতে প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য কামনা করেন। তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করেও একটি স্ট্যাটাস দেন।

আবু জাফর মিয়া লেখেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমাদের বাঁচান। আমরা নিরপরাধ। আমরা আওয়ামী লীগের কর্মী। আমরা ষড়যন্ত্রের শিকার। প্লিজ আমাদের বাঁচান। আমরা সাধারণ ছাত্র। প্লিজ আমাদের উদ্ধার করুন। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ।’

আরেকটি পোস্টে জাফর লেখেন “সাংবাদিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর স্যারদের উদ্দেশ্য করে বলছি, আমরা নিরপরাধ। আমরা কখনো শিবির, জঙ্গিবাদ সম্পর্কে ভালো করে জানিও না। প্লিজ আপনারা আমাদের সার্চ করুন। দেখুন কিছু পান কিনা। আমরা নিরপরাধ। বাইরে থেকে আমাদের ছিটকিনি লাগানো। প্লিজ ছিটকিনি খুলে আমাদের উদ্ধার করুন।”

তা ছাড়া ভেতরে থাকা তরুণেরা রাত থেকেই ফোনে আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করছিলেন। অনেক বছর নরসিংদীর উত্তর গাবতলিতে থাকায় তাঁদের স্থানীয় ফেসবুক বন্ধুও ছিলেন।

রোববার সকালে র‌্যাব চূড়ান্ত অভিযান চালাবে এমন ঘোষণার পরপরই এলাকার বাসিন্দারা অভিযানস্থলের আশপাশে জড়ো হন। উপস্থিত সাংবাদিকেদরও তাঁরা ফেসবুক পোস্টটি দেখান। আটকে থাকা তরুণদের স্বজনের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দেন।

স্থানীয় এক ব্যবসায়ী রোববার মোটরসাইকেলে করে ঘটনাস্থলের দিকে এগোচ্ছিলেন। সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর তিনি তাঁর মুঠোফোন থেকে ফেসবুক পোস্টের স্ক্রিনশট দেখান।

“আপনারা প্লিজ একটু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দেখান। এখানে কেউ যেন অবিচারের শিকার না হয় সেটা একটু দেখেন সবাই মিলে। আমরা কোনো রক্তপাত চাই না,” ওই ব্যবসায়ী বলেন।

বেসিক এডুকেশন একাডেমি নামে স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকও বলেন, তিনিও তরুণদের চেনেন। তাঁদের একজন তাঁর সহকর্মী ছিলেন।

রোববার সকাল ৯টার কিছু পরে র‌্যাব মুখপাত্র মুফতি মাহমুদ খান জানান, তাঁরা ভেতরে থাকা সবার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। সবাই আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয়েছেন।

এরপর সকাল ৯টা ৫৫ থেকে ১০টা ২৭ মিনিটের মধ্যে পাঁচজনই বেরিয়ে আসেন।

পরে ঘটনাস্থলের কাছে প্রেস ব্রিফিংয়ে র‌্যাবের মুফতি মাহমুদ খান জানান, বাড়িটি চলতি মাসের ৩ তারিখ ভাড়া নেওয়া হয়। জমা দেওয়া ভাড়াটিয়া তথ্য ফরমে যাদের তথ্য দেওয়া হয়েছিল, তাদের কেউ কেউ বাড়িতে থাকেন না। অন্য আরও দু-তিনজন থাকেন। যাদের ভাড়া নেওয়ার কথা ছিল তাদের সঙ্গে জঙ্গিদের যোগাযোগ আছে কি না খতিয়ে দেখতে হবে।

অভিভাবকেরা যা বললেন

মশিউরের মেস র‌্যাব ঘিরে রেখেছে শনিবার রাতেই খবর পেয়ে তাঁর নানা আবদুল হাই ভোরে ভৈরবের বাঁশগাড়ি থেকে নরসিংদিতে চলে আসেন। বেনারের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, “আমার নাতি কামিল পাস করেছে অল্পদিন আগে। সে আরএফএলের স্টলে কাজও করেছে কিছুদিন। চাকরি স্থায়ী হয়নি। আজ (রোববার) ঢাকায় চাকরি স্থায়ীর পরীক্ষা ছিল। কী বিপদ হইল!”

তিনি জানান, মশিউর রহমানের বাবা একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক।

সেখানে অপেক্ষা করছিলেন সালাউদ্দীনের বাবা আবদুর রহমানও। ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এ খবর জানিয়ে এসেছিলেন র‌্যাবকে। তাঁরাও বিবেচনা করবেন বলে জানান।

তবে রাতের দিকে সালাউদ্দীনের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেয় র‌্যাব। আবদুর রহমান বলেন, “তাঁর ছেলে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না। তার আচার-আচরণও অস্বাভাবিক না। শুক্রবার সে নরসিংদিতে তার গ্রামের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এসেছে।”

বাসিকুল ইসলামের ভাই শফিকুর ইসলাম জানান, তাঁর ভাইও শনিবার রাতে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। রাতেই তাঁরা গ্রামের বাড়ি থেকে চলে আসেন। কীভাবে কী হলো বুঝতে পারছেন না।

যেখানে অসংগতি

গত বছরের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার পর জঙ্গিবাদ বিরোধী অভিযানে যারা গ্রেপ্তার ও নিহত হয়েছেন তাঁদের সঙ্গে পরিবারের যোগাযোগ ছিল না। তাঁরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ‘তাগুত’ বা শত্রু বলে মনে করে। অভিযানের সময় তারা পুলিশ-র‌্যাবের দিকে বোমা ছুড়ে মারে।

এ ছাড়া অভিযানের পরও ঘটনাস্থলের চারপাশে পুলিশ মোতায়েন থাকতে দেখা গেছে লম্বা সময়। নরসিংদীর অভিযান এসব দিক বিবেচনায় ছিল আলাদা।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক প্রধান নির্বাহী নূর খান বেনারকে বলেন, “অভিযানগুলো পরিকল্পিত ও সুচিন্তিত হওয়া প্রয়োজন।”

“জঙ্গিবাদ একটি মারাত্মক সমস্যা। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের সমস্যা রয়েছে। মানুষের সমর্থন নিয়ে এই সমস্যা দূর করতে হবে। এ নিয়ে যেন কোনো প্রশ্ন না ওঠে সে বিষয়ে খুব সতর্ক থাকা দরকার,” বলেন তিনি।

রোববার বিকেলের দিকে ওই বাড়ির চারপাশ ঘিরে জটলা ছিল। তাসলিমা বেগম নামের একজন নারী বলেন, তাঁর কাছ থেকে তালা নিয়ে র‌্যাব বাইরে থেকে আটকে গেছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।