আইনজীবী নিখোঁজ: সন্দেহ ধর্মান্ধ শক্তিকে ঘিরে

শরীফ খিয়াম
2018.04.02
ঢাকা
নিখোঁজ রথীশ চন্দ্র ভৌমিককে উদ্ধারের দাবিতে সিরাজগঞ্জে পূজা উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে শহরে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়। নিখোঁজ রথীশ চন্দ্র ভৌমিককে উদ্ধারের দাবিতে সিরাজগঞ্জে পূজা উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে শহরে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়। ২ এপ্রিল ২০১৮।
নিউজরুম ফটো

আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির অস্থিতিশীলতা তৈরির অপচেষ্টার অংশ হিসেবেই রংপুরের আইনজীজী রথীশ চন্দ্র ভৌমিক নিখোঁজ হয়েছেন বলে দাবি করেছেন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত

“বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলায় জঙ্গিদের বিরুদ্ধে তিনি (রথীশ) লড়েছেন। যুদ্ধাপরাধী আজাহারের (জামায়াতে ইসলামীর নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের) বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় সাক্ষীও দিয়েছেন তিনি,” বেনারকে বলেন রানা দাশগুপ্ত।

“আবার একইসঙ্গে রথীশ হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের রংপুরের বিভাগীয় ট্রাস্টি। বিগত ২-৩ বছরে তিনি স্থানীয়ভাবে বেদখল থাকা প্রায় তিনশ কোটি টাকার দেবত্তোর (হিন্দু উপাসনালয়ের) সম্পত্তি উদ্ধার করেছেন,” যোগ করেন তিনি।

রথীশের ভাই, দৈনিক খোলা কাগজের রংপুর বিভাগীয় অফিসের প্রধান সুশান্ত ভৌমিক সুবল বেনারকে জানান, গত শুক্রবার সকালে রংপুরে নিজের বাড়ি থেকে বের হন রথীশ। মুঠোফোন বন্ধ রেখে সন্ধ্যায়ও বাড়িতে ফিরে না আসায় বিভিন্ন জায়গায় তাঁর খোঁজ করেন পরিবারের সদস্যরা। কোথাও না পেয়ে পরে রাতেই রংপুর কোতোয়ালি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়।

প্রথমে জিডি করলেও পরে মামলা করা হয় জানিয়ে বাদী সুবল বেনারকে বলেন, “মামলায় রথীশ ‘নিখোঁজ’ বলে অভিযোগ করা হয়েছে।”

দেবত্তোর সম্পত্তি উদ্ধারে তৎপরতার কারণে রথীশের ‘স্থানীয় শত্রু’ বেড়ে গিয়েছিল বলেও মন্তব্য করেন সুবল।

তিনি বলেন “সম্প্রতি জাপানী নাগরিক ও খাদেম হত্যা মামলা পরিচালনার পাশাপাশি জমিজমা, মানে দেবত্তোর সম্পত্তি উদ্ধারে তৎপর হওয়ায় তার শত্রু সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল।”

“এ ঘটনায় আমরা দু’একজনকে সন্দেহের তালিকায় রেখেছি। তদন্তের স্বার্থে তা আপাতত গণমাধ্যমে বলছি না,” রোববার রথীশ চন্দ্রের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাত শেষে সাংবাদিকদের বলেন পুলিশের রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুখ।

অ্যাডভোকেট রথীশ নিখোঁজ হলেন, না অপহরণ হলেন তা বের করার চেষ্টা চলছে বলেও জানান তিনি।

প্রসঙ্গত, গত ১৮ মার্চ রংপুরের মাজারের খাদেম রহমত আলী হত্যা মামলায় নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) ৭ সদস্যকে ফাঁসির আদেশ দেয় বিশেষ জজ আদালত।

এর মধ্যে মাসুদ রানা, ইছাহাক আলী, লিটন মিয়া ও সাখাওয়াত হোসেনের জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি হত্যা মামলায়ও মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। বর্তমানে রংপুর কারাগারে আছে তারা।

আলোচিত এই দুটি মামলায় সরকার পক্ষের প্রধান কৌসুলি ছিলেন রংপুর বিশেষ জজ আদালতের বিশেষ পিপি (পাবলিক প্রসিকিউটর) অ্যাডভোকোটে রথীশ।

এছাড়া জামায়াতের আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের ছয়টি মামলার তিনটিতে ফাঁসি, একটিতে ২৫ বছর এবং আরেকটি অভিযোগে পাঁচ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়।

অক্ষত উদ্ধারের চেষ্টা চলছে

রংপুর কোতোয়ালি থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বাবুল মিয়া সোমবার বিকেলে বেনারকে বলেন, “বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। যেন কোনোভাবেই খারাপ কিছু না ঘটে। যাতে তাঁকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা যায়। পুলিশের একাধিক টিম তাঁকে উদ্ধারের লক্ষ্যে কাজ করছে।”

এদিকে রানা দাশগুপ্ত বেনারকে বলেন, “আজকে (সোমবার) আমরা জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি সংবাদ সম্মেলন করেছি এবং আমরা সেখানে নিখোঁজকে উদ্ধারে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ কামনা করেছি।”

পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল মিয়া বেনারকে বলেন, “তাঁর (রথীশের) অবস্থান বের করার জন্য আমরা অনেক লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করছি। তবে কাউকে আটক বা গ্রেফতার করা হয়নি।”

“তবে তদন্ত খুব দ্রুত এগিয়ে চলছে,” যোগ করেন তিনি।

আতঙ্কে সংখ্যালঘুরা

বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা রানা দাশগুপ্ত বলেন, “এই ঘটনায় দেশের আড়াই কোটি সংখ্যালঘু শঙ্কাগ্রস্থ হয়ে পড়েছে। এমনিতেই আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে তাঁদের মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা ও নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছে।”

“রথীশকে যদি অনতিলম্বে উদ্ধার করা না যায়, তবে এই শঙ্কা ও নিরাপত্তাহীনতা আরো বাড়বে। যেটা আগামী নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতেও পারে,” যোগ করেন তিনি।

রানা দাশ বলেন, “ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি এই ঘটনাটি করেছে। আমরা মনে করি, নির্বাচন যতই সামনে আসবে ততই এই গ্রুপের তৎপরতা বাড়বে।”

অব্যাহত হামলা ও হুমকির মুখে আতঙ্কে থাকা সংখ্যালঘু বাংলাদেশের আহমদীয়া মুসলিম জামা’ত সম্প্রদায়ের কেন্দ্রীয় নেতারাও রোববার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছেন, “আসন্ন নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে মৌলবাদিরা দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির পায়তারা চালাচ্ছে।”

এ ঘটনার কথা উল্লেখ করে রানা দাশ আরো বলেন, “সবই এক সুঁতোয় গাঁথা। সরকার যতই বলুক জঙ্গিদমন করেছে, তা সত্য নয়। কিছু লোককে মেরে ফেলে জঙ্গিবাদ দমন করা সম্ভব নয়।”

অন্যদিকে এ ঘটনায় গত কয়েক দিন ধরেই উত্তপ্ত হয়ে আছে রংপুরের রাজপথ। রথীশকে উদ্ধারের দাবিতে সমাবেশ ও মানববন্ধন করার পাশাপাশি জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে স্মারকলিপিও দিয়েছে বিভিন্ন সংগঠন।

“আমরা ৭ এপ্রিল সকাল ১০টা থেকে ১১টা রংপুর ও রাজশাহীর সকল জেলা এবং দেশের সবগুলোর বিভাগীয় শহরের প্রধান সড়ক অবরোধের কর্মসূচি ঘোষণা করেছি,” বলেন রানা দাশগুপ্ত।

সুশান্ত ভৌমিক সুবল বেনারকে জানান, রথীশের স্ত্রী স্থানীয় একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তাঁর বড় ছেলে ঢাকায় ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে আইন নিয়ে পড়ছে। আর ছোট মেয়ে নবম শ্রেণির ছাত্রী।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।