এবার নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা বিরোধিতায় ইসলামি দলগুলো
2017.04.13
ঢাকা

বাংলা নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে ইউনেস্কো ঘোষণা দেবার এক বছরের মাথায় ওই শোভাযাত্রা বন্ধের দাবি তুলছে ইসলাম ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো। তাদের দৃষ্টিতে ইসলাম এ ধরনের কর্মকাণ্ড সমর্থন করে না।
এই পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে এবার রাজধানীসহ দেশজুড়ে পয়লা বৈশাখের আয়োজন সীমিত করতে বলেছে প্রশাসন। ইতিমধ্যে জেলায় জেলায় বর্ষবরণের আয়োজন বিকেল পাঁচটার মধ্যে শেষ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
রাজধানীতেও পুলিশের পক্ষ থেকে এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট এবার রবীন্দ্রসরোবরে তাদের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ইউনেস্কো বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ঘোষণার পর এ বছর বিশাল কলেবরে মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজন করার কথা। এর অংশ হিসেবে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নববর্ষে মঙ্গল শোভাযাত্রা করাটা বাধ্যতামূলক করা হয়।
তবে বিভিন্ন ইসলামি দল ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানানোর পর বিষয়টি নিয়ে সরকার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা দ্বিধায় পড়েছেন। এর আগে ২০০১ সালে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলাসহ বেশ কয়েকটি সহিংস ঘটনা ঘটে। সাম্প্রতিক সময়ে আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনাগুলোও নতুন আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।
সর্বশেষ গত বুধবার চট্টগ্রামে দেয়ালচিত্রে আঁকা বাংলার লোকজ সংস্কৃতি পোড়া মবিল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে।
এসব ঘটনায় পহেলা বৈশাখের আগে এক ধরনের অস্বস্তি রয়েছে দেশজুড়ে। এরই মধ্যে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বক্তব্য ও ভূমিকা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া গত প্রায় এক সপ্তাহ ধরে পয়লা বৈশাখের নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলছেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, উন্মুক্ত স্থানের অনুষ্ঠান বিকেল পাঁচটার মধ্যে শেষ করতে হবে। মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেওয়া প্রতিটি লোককে তল্লাশি করা হবে। কাউকে মুখ ঢেকে চলতে দেওয়া হবে না। মুখোশ হাতে নিতে হবে। ভুভুজেলা বাজানো যাবে না।
ইসলামি দলগুলোর দাবি, এই মঙ্গল শোভাযাত্রা ইসলামি সংস্কৃতি এমনকি বাঙালি সংস্কৃতিরও অংশ নয়। ইসলামি ঐক্যজোট চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী বেনারকে বলেন, “এসব বিধর্মীয় প্রথা পালনের জন্য দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে বাধ্য করার উদ্যোগ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা এই শোভাযাত্রায় অমুসলিমদের প্রতীক ও উপমা ব্যবহার করা হয়। যা ইসলাম পরিপন্থী।”
এ প্রসঙ্গে সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি ও নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বেনারকে বলেন “রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই ইসলামি দলগুলো মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে আপত্তি তুলছে। গোটা দেশে এটা পালন করা হয়। অবশ্যই এবারের শোভাযাত্রা আগের চেয়ে বেশি ধুমধামের সঙ্গে পালিত হবে।”
“সবচেয়ে বড় কথা হলো—এই মঙ্গল শোভাযাত্রা রক্ষা করার জন্য ইউনেস্কো এবং বাংলাদেশ সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ,” বলেন তিনি।
কী এই মঙ্গল শোভাযাত্রা
আশির দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখে এই মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু হয়। এরপর থেকে প্রতিবছরই বাংলা নববর্ষ বরণে মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। পহেলা বৈশাখে ঢাকার বাইরেও মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রচলন শুরু হয়েছে।
আয়োজকদের মতে, এই মঙ্গল শোভাযাত্রা শুধু উৎসবের অনুষঙ্গ নয়, এর মধ্য দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতিকে মেলে ধরা হয়।
গত বছরের ৩০ নভেম্বর ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ পরিচয় নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণের এই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান দেয় জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেস্কো।
বিক্ষোভের হুমকি
এই শোভাযাত্রায় নির্দিষ্ট ধর্মের দেবদেবীদের আকৃতির চিহ্ন বহন করা হয় অভিযোগ এনে এটি সারা দেশে পালন বাধ্যতামূলক না করার দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক ইসলামি দলগুলো। ইসলামি ঐতিহ্য সংরক্ষণ কমিটি নামে একটি সংগঠনের মাধ্যমে এই আন্দোলন চলছে।
গত ৩১ মার্চ বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে তারা। আগামী ২২ এপ্রিল আরও একটি সমাবেশের ঘোষণাও দিয়েছে সংগঠনটি।
এই কমিটির প্রচার সেলের সদস্য মাওলানা সুলতান মহিউদ্দীন বেনারকে বলেন, “মঙ্গল শোভাযাত্রা কোনোভাবেই ইসলামি সংস্কৃতি নয়। এটা বাঙালি সংস্কৃতির অংশও নয়।”
তাঁর মতে, “এই শোভাযাত্রায় একটি নির্দিষ্ট ধর্মের দেব-দেবীদের আকৃতির চিহ্ন বহন করা হয়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে এই সংস্কৃতি চলতে পারে না।”
পিছপা হওয়ার সুযোগ নেই
সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বেনারকে জানিয়েছেন, “কারও, কোনো দাবিতে পিছপা হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। বরং অন্যান্যবারের চেয়ে এবারের পহেলা বৈশাখের আয়োজন ও মঙ্গল শোভাযাত্রা আরও বেশি আড়ম্বরপূর্ণ হবে।”
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, “সারা দেশের সংস্কৃতি কর্মীরা প্রশাসন ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর দ্বিমুখী চাপে রয়েছেন। মঙ্গল শোভাযাত্রা ও নববর্ষ উৎসবের বিরুদ্ধে যে প্রচারণা চালানো হচ্ছে, তা অশনিসংকেত। তারপরও সংস্কৃতিকর্মীরা অপশক্তির কাছে মাথা নত করবে না।”