এখনো সাংসদ লিটন হত্যার ক্লু নেই, সন্দেহ বিভিন্ন দিকে
2017.01.03

জামায়াত, জঙ্গি, দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও স্বজনদের সংশ্লিষ্টতা—এই চারটি সম্ভাব্য বিষয় মাথায় রেখে গাইবান্ধা–১ আসনের সাংসদ মো. মনজুরুল ইসলাম লিটন হত্যার তদন্ত চলছে। সরকার ও দলের পক্ষ থেকে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতার কথা বলা হলেও তদন্ত কর্মকর্তারা অন্য বিষয়গুলো উড়িয়ে দিতে পারছেন না।
গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত এই সাংসদকে হত্যার ক্লু খুঁজে পায়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। যদিও ঘটনার পরপরই রহস্য উদঘাটনে পুলিশ, পুলিশের বিশেষায়িত শাখা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও র্যাব মাঠে নামে। গতকাল পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর ৩৩ কর্মী ও সমর্থককে আটক করা ছাড়া মামলার আর কোনও অগ্রগতি নেই।
গত শনিবার গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে নিজ বাড়িতে নিহত হন মঞ্জুরুল ইসলাম। গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “জামায়াতের বিরুদ্ধে লড়াই করে লিটন সেখানে দলকে একটি পর্যায়ে নিয়েছিল। সে একাধিকবার হামলার শিকারও হয়েছিল। সর্বশেষ সে যখন হামলার শিকার হয়, তখন কেবল শিশুটির গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। কিন্তু সে যে আক্রান্ত হয়ে গুলি করেছিল, এটা তখন কেউ বলেনি।”
এই হত্যাকাণ্ড ঘিরে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব মিলছে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা বেনারকে বলছেন, শুরুতেই কোনো একটি পক্ষকে দায়ী করলে সুষ্ঠু তদন্তে বিঘ্ন ঘটতে পারে।
“সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে তদন্ত পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। পুলিশ সদর দপ্তরের একটি দল ঘটনাস্থলে রাখা হয়েছে। তদন্তে সব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে,” বেনারকে জানান পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক মনিরুজ্জামান।
জঙ্গিদের সম্পৃক্ততা
সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়লেও জঙ্গিরা হত্যাকাণ্ডের পেছনে ছিল কি না, তা ভাবা দরকার বলে মনে করছেন সাংসদের স্বজন ও অনুসারীরা। জঙ্গিরা তাদের গতানুগতিক হত্যার কৌশল পাল্টাতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
ঘটনার দিন সাংসদের বাড়ির সামনে খেলছিল এমন কয়েকটি ছেলে স্থানীয় সাংবাদিকদের জানায়, তারা সাংসদের বাড়ির সামনে মুখে দাড়ি থাকা একজন ব্যক্তিকে দেখেছিল। তারা সাংসদের কাছে খেলার সরঞ্জাম চাইতে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে চাইলে ওই ব্যক্তি তাদের বাধা দেয়। বাধা পেয়ে ফিরে যাওয়ার সময়ই তারা গুলির শব্দ শুনতে পায়। ওই ছেলেরা আরও জানায়, সে সময় তারা যাদের দেখেছিল তাদের কারও মুখ ঢাকা ছিল না।
“তদন্তে খুঁটিনাটি কোনো বিষয়ই বাদ যাবে না, তাঁর রাজনৈতিক জীবনসহ সব কিছুই বিবেচনা করা হচ্ছে,” বেনারকে জানান গাইবান্ধার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহ আল ফারুক।
এজাহারে সাংসদের বোন যা বলেছেন
লিটন হত্যাকাণ্ডের দুদিন পর তাঁর বোন ফাহমিদা বুলবুল গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করেন। সেখানে তিনি বলেন, “গত ১৪ ডিসেম্বর সাংগঠনিক কাজে তাঁর ভাই সস্ত্রীক গাইবান্ধায় আসেন। গাইবান্ধার মাস্টারপাড়ায় নিজ বাড়িতে বসে তিনি দাপ্তরিক ও সাংগঠনিক কাজ করতেন। ১ জানুয়ারি তাঁর ঢাকায় ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। ঘটনার দিন মাগরিবের নামাজের পর আনুমানিক সন্ধ্যা সাড়ে ৫ টার দিকে বৈঠকখানায় বসেছিলেন।”
হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, “এমন সময় পাঁচজন দুষ্কৃতকারী আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে দেখা ও কথা বলার অজুহাতে বৈঠকখানায় ঢুকে তাদের সঙ্গে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র থেকে এমপির বুকের ডানদিকে দুটি, বাম হাতের তালুতে দুটি এবং পিঠের ডানপাশে একটি—মোট পাঁচটি গুলি করে। এ সময় আমার বড় ভাবী ও এমপি সাহেবের স্ত্রী সৈয়দা খুরশিদ জাহান স্মৃতি এবং তাঁর বড় ভাই সৈয়দ বেদারুল আহসান বেতার পাশের ঘরে ছিলেন।”
এজাহারে আরও বলা হয়, “তাঁরা তাঁকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করেন ও পাঁচজনকে বের হয়ে যেতে দেখেন। তাঁদের গাড়িচালক মো. ফোরকান আলীসহ অন্যরা বেরিয়ে এলে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়।”
বেশ কিছু প্রশ্ন
গাইবান্ধা-১ আসনের সাংসদ লিটন বেপরোয়া প্রকৃতির ছিলেন বলে অভিযোগ আছে। তিনি নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন—এমন অভিযোগও বিভিন্ন সময় তুলে ধরে সংবাদ মাধ্যম।
সাংসদ ও তাঁর বাহিনীর তৎপরতার বিষয়টি সবার সামনে আসে ২০১৫ সালের ২ অক্টোবর শিশু শাহাদৎ হোসেন সৌরভকে গুলি করার পর। শিশু সৌরভ গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আদালত লিটনকে গ্রেপ্তার করতে পুলিশকে নির্দেশ দেয়। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সৌরভের পরিবার তখন বলেছিলেন, সাংসদের ক্যাডার বাহিনী তাঁদের অনবরত হুমকি দিচ্ছে।
প্রশ্ন উঠেছে—হত্যাকাণ্ডের সময় সাংসদের সেই বাহিনী কোথায় ছিল? তাঁদের কেউ কেন তখন তাঁর সঙ্গে ছিলেন না? দলীয় লোকজনই বা তখন কোথায় ছিল?
“বাড়িতে বিভিন্ন কাজের জন্য সাতজন মানুষ থাকলেও, হত্যাকাণ্ডের সময় ধারেকাছে কেউ ছিল না। এ ঘটনায় আমরা খুবই বিস্মিত হচ্ছি,” বেনারকে জানান সাংসদের বোন ফাহমিদা বুলবুল।
তিনি বলেন, ঘটনার সময় বাড়িতে শুধু সাংসদের স্ত্রী সৈয়দা খুরশিদ জাহান স্মৃতি ও তাঁর ভাই সৈয়দ বেদারুল ইসলাম বেতার ছিলেন।
ফাহমিদা আরও বলেন, “আমার বড় ভাই লিটনের সততা, দলের প্রতি আনুগত্য অনেকের ঈর্ষার বিষয় ছিল।”
তবে সাংসদের স্ত্রী সৈয়দা খুরশিদ জাহান এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে জামায়াত ছাড়া আর কেউ জড়িত থাকতে পারে বলে মনে করছেন না।
“২০০১ সালে গোলাম আজমের জনসভা আমার স্বামী ভণ্ডুল করে দেন। ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর রায়ের পর জামায়াতের লোকজন বামনডাঙা পুলিশ ফাঁড়ির চার পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে। সে সময়ও তাঁকে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল। ২০১৪ সালে সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর এলাকায় জামাতের রাজনীতি কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এসব কারণে জামায়াতের নেতারা খুব ক্ষিপ্ত ছিল,” বেনারকে জানান খুরশীদ জাহান।
এদিকে ওই পরিবারের ঘনিষ্ঠ লোকজন বলছেন, হত্যাকাণ্ডের সময় ঘরে থাকা লোকজন কী করছিলেন, সেটি জানা দরকার। যে পাঁচজন এসেছিল তাঁরা মুখোশ পরে আসেনি এবং সবার চোখের ওপর দিয়েই বেরিয়ে গেছে। গাড়িচালকও কিছু দূর পর্যন্ত তাদের ধাওয়া করেছিল, পরে ফিরে আসে। তাঁরা আরও বলছেন, দলে তাঁর কর্মকাণ্ডে কারা অসন্তুষ্ট ছিলেন, সেটিও বিবেচনায় নেওয়া উচিত।