মুফতি হান্নানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর, এক কালো অধ্যায়ের অবসান
2017.04.12
ঢাকা

নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ, বাংলাদেশের নেতা মুফতি মো. আবদুল হান্নান ও তাঁর দুই সহযোগী শরীফ শাহেদুল ওরফে বিপুল এবং দেলোয়ার হোসেন রিপনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।
পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহিদুল হক সাংবাদিকদের জানান, রাত ১০টায় একই সাথে গাজীপুরে হাই সিকিউরিটি প্রিজনে মুফতি হান্নান ও শরীফ শাহেদুল আলম ওরফে বিপুল এবং সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে দেলোয়ার হোসেন রিপনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
প্রসঙ্গত গত ২৭ মার্চ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মুফতি হান্নান ও তার দুই সহযোগী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করেন। গত রোববার রাষ্ট্রপতি তাঁদের প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ করে দিলে বিধি অনুযায়ী কারা কর্তৃপক্ষ ফাঁসি কার্যকরের উদ্যোগ নেয়।
এর আগে বুধবার সকালে মুফতি হান্নানের স্বজনেরা কারাগারে তাঁর সাথে দেখা করেন বলে বেনারকে জানান গাজীপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক মো. মিজানুর রহমান।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে হাইকোর্ট বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর ২০০৪ সালের ২১ মে তে গ্রেনেড হামলা ও তিনজনকে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়।
মুফতি হান্নান আপিল করলে, হাইকোর্ট সেই আপিল খারিজ করে আগের রায় বহাল রাখে। বিচারিক আদালত মৃত্যু পরোয়ানা জারি করলে, সেই রায়ও পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন মুফতি হান্নান। তবে খারিজ হয় সেই আবেদনও। শেষ পর্যন্ত ফাঁসির দণ্ড মওকুফে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার আবেদনও খারিজ হয়ে যাওয়ায় কার্যকর হলো মৃত্যুদণ্ড।
এদিকে এই তিন আসামির মৃতুদণ্ড কার্যকর করার বিপক্ষে ছিল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) ও যুক্তরাজ্য সরকার।
গত ২২ মার্চ এইচআরডব্লিউ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, তারা যেকোনো দেশে, যেকোনো পরিস্থিতিতেই সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করে।
অন্যদিকে এক ই-মেইল জবাবে গত ২২ মার্চ ঢাকার ব্রিটিশ হাইকমিশন বেনারকে জানায়, “যুক্তরাজ্য সকল পরিস্থিতিতে মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে তার দীর্ঘদিনের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করছে।”
হুজির সমাপ্তি হলেও স্বস্তি সাময়িক
মুফতি হান্নানের মৃত্যুদণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে হরকাতুল জিহাদ (হুজি–বি)র তৎপরতার অবসান হলো বলে মনে করেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন।
এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বেনারকে বলেন, “স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি জঙ্গি হামলার জন্য দায়ী সংগঠন হলো হরকাতুল জিহাদ, বাংলাদেশ। এর মধ্যে মুফতি হান্নানের নেতৃত্বে ১৩টি হামলা হয়েছে, নিহত হয়েছে শতাধিক মানুষ, আহতের সংখ্যা ৬শ’র মতো। উদীচীর বোমা হামলা দিয়ে ১৯৯৯ সালে হুজি বি যে তৎপরতার শুরু তার সমাপ্তি হতে পারে এই মৃত্যুদণ্ডের মধ্য দিয়ে।”
তবে এই মৃত্যুদণ্ডকে, “নিঃসন্দেহে নিহত সংস্কৃতি কর্মী ও আহতদের জন্য স্বস্তিদায়ক” মনে করলেও এই স্বস্তি সাময়িক বলে আশঙ্কা করেন উদীচীর সম্পাদক জামসেদ আনোয়ার।
তিনি বেনারকে বলেন, “ধর্মান্ধ গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সরকার ধারাবাহিকভাবে আপস করে যাচ্ছে, হুজি বি নিষ্ক্রিয় হলেও অন্য নামে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাবে।”
দুর্ধর্ষ জঙ্গির উত্থান
মুফতি আবদুল হান্নানের বাড়ি গোপালগঞ্জে। প্রথমে গোপালগঞ্জের একটি মাদ্রাসায় ও পরে ১৯৮৭ সালে পাকিস্তানের করাচিতে একটি মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে পড়ার সময়ই জঙ্গিবাদে হাতেখড়ি হয় তাঁর। তিনি আফগানিস্তানে রুশ সৈনিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। সেখান থেকে ফির ১৯৯৪ সালে হরকাতুল জিহাদ, বাংলাদেশ (হুজি–বি) গঠন করেন।
কিছুদিন আগে আদালতের পথে তাকে প্রিজন ভ্যান থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়। কারাগারে থেকে তিন বাইরে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলেন বলেও খবর প্রকাশিত হয় দেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে।
কেবলমাত্র শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তিনটি পরিকল্পনা করেন মুফতি হান্নান। ২০০০ সালের ২১ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশ স্থলের কাছে ৭৬ কেজি বোমা পুঁতে রাখার ঘটনায় বিষয়টি সামনে আসে। এ পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে ২০০১ সালে ৩০ মে খুলনার রূপসা সেতুর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা হয়। পুলিশ ১৫ হুজি জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে।
এরপর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে আর্জেস গ্রেনেড দিয়ে হামলা চালানো হয়। ওই হামলায় আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ নিহত হন ২২ নেতা-কর্মী।
গ্রেপ্তারের পর ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে এসব বিষয়ে স্বীকারোক্তি দেন মুফতি হান্নান।
মুফতি হান্নানই যে ১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচীর সম্মেলনে হামলা চালান, সে বিষয়টি বেরিয়ে আসে তাঁর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি থেকে। উদীচীর সম্মেলনে বোমা হামলায় ১১জন নিহত হন, পরের বছর যশোরে সাংবাদিক শামসুর রহমান কেবল হত্যাকাণ্ড ও ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনা বটমূলে বাংলা বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে বোমা হামলায় প্রাণ হারান ১০ জন।
২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্ত করছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)র উপ মহাপরিদর্শক আবদুল কাহহার আকন্দ।
তিনি বেনারকে বলেন, “মুফতি হান্নান শুধু নিজেই সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন না। সব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনাকারীও ছিলেন।”
"মুফতি হান্নান প্রথম দিককার হামলাগুলোয় দেশি বোমা ব্যবহার করতেন। পরে পাকিস্তান থেকে গ্রেনেড সংগ্রহ করতে শুরু করেন। বোমা বানানো এবং আক্রমণ বিষয়ে তিনি হুজি সদস্যদের প্রশিক্ষণও দিয়েছেন,” আবদুল কাহহার আকন্দ বলেন।
মৃত্যুদণ্ড বেড়েছে বাংলাদেশে
সম্প্রতি প্রকাশিত বিভিন্ন দেশের মৃত্যুদণ্ডের পরিসংখ্যান নির্ভর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর গ্লোবাল রিপোর্ট ২০১৭ অনুযায়ী ২০১৬ সালে বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পরিমাণ ছিল আগের বছর থেকে আড়াই গুণ বেশি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৫ সালে বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় ৪টি আর ২০১৬ সালে ১০টি।
এছাড়া ২০১৬ সালে মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে অন্তত ২৪৫টি এবং বছরের শেষে বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মোট আসামির সংখ্যা ছিল অন্তত ১৬৪৫জন।