জনগণের সঙ্গে পুলিশকে ‘সদাচারণ’ করতে আইজিপির নির্দেশ
2017.07.31
ঢাকা

সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া পরপর তিনটি ঘটনায় সমালোচনার প্রেক্ষিতে জনবিশৃঙ্খলা এড়াতে পুলিশকে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ না করার নির্দেশ দিয়েছেন মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক। গত রোববার পুলিশ সদরদপ্তরে আয়োজিত ত্রৈমাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় তিনি মাঠপর্যায়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে সতর্ক করেন।
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, বৈঠকে ওই ঘটনাগুলো নিয়ে আলোচনা হয় এবং এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না হয় সে ব্যাপারে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সতর্ক করা হয়। এসময় জেলা পর্যায়ের সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও সমন্বয় ও সুসম্পর্ক বজায় রেখে দায়িত্ব পালনের জন্য মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা প্রদান করেন আইজিপি।
জানতে চাইলে পুলিশ সদরদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক সহেলী ফেরদৌস (গণমাধ্যম) বলেন, সভায় সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনা পর্যালোচনা করা হয়। তার ভিত্তিতে আইজিপি নির্দেশনা জারি করেন। তিনি মূলত জনগণের সঙ্গে ‘সদাচারণ’ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
“আইজিপি মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের জনগণের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়তে বলেছেন। অপরাধ দমনেও জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। বিভিন্ন জায়গায় বর্তমানে কমিউনিটি পুলিশিং চালু হয়েছে। জনগণের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থা জোরদার করার কথা বলেছেন আইজিপি,” সহেলী ফেরদৌস বেনারকে বলেন।
পুলিশ মহাপরিদর্শকের সভাপতিত্বে আয়োজিত ওই সভায় ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার, পুলিশের প্রতিটি রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক, পুলিশের বিশেষ শাখা-এসবি ও অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির প্রধান, পুলিশ সদরদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, প্রত্যেক জেলার পুলিশ সুপার উপস্থিত ছিলেন।
পুলিশ সদরদপ্তর থেকে ভাইবারে এই নির্দেশনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন, সহকারি মহাপরিদর্শক (গোপনীয়) মনিরুজ্জামান।
গত ২০ জুলাই রাজধানীর শাহবাগে পুলিশের ছোড়া টিয়ার শেলের আঘাতে রাজধানীর তিতুমীর কলেজের ছাত্র সিদ্দিকুর রহমানের চোখ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর দুদিন আগে গত ১৮ জুলাই পুলিশ হেফাজতে খুলনায় শাহজালাল নামের এক ‘ছিনতাইকারী’ পুলিশের ভোঁতা অস্ত্রের আঘাতে দৃষ্টি শক্তি হারান বলে অভিযোগ ওঠে।
তা ছাড়া ১৯ জুলাই বরগুনায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তারিক সালমানকে হাতকড়া পরিয়ে জেলহাজতে নেওয়ার ঘটনায়, পুলিশের সঙ্গে প্রশাসনের দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। তারিক সালমানকে পুলিশ হাতকড়া পরিয়ে আদালত চত্বর থেকে নিয়ে আসেন এমন একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে ভাইরাল হলে প্রশাসনে নিয়োজিত কর্মকর্তারা বিবৃতি দিয়ে এর প্রতিবাদ জানান।
পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা নিজেই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বলেন, আসামি আনা নেওয়ার ক্ষেত্রে কঠোরতা পালন করতে হবে তখনই, যখন আসামির পালিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। সে ক্ষেত্রে উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদধারীর প্রতি এমন আচরণ অগ্রহণযোগ্য।
বলপ্রয়োগের ঘটনায় পুলিশ ‘বিব্রত’
রাজধানীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাতটি কলেজের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার রুটিন প্রকাশের দাবিতে আন্দোলন করছিল। গত ২০ জুলাই জমায়েতের খুব কাছ থেকে পুলিশ টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। ঘটনার পর ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া পুলিশের পক্ষ নেন। পরে ওই ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ও অন্যান্য তথ্য সংগ্রহের পর তিনি চুপ হয়ে যান।
খুলনায় শাহজালালের দৃষ্টিশক্তি হারানোর ঘটনায় খুলনা মহানগর পুলিশের খালিশপুর জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার বলেন, শাহজালাল ছিনতাই করে পালানোর সময় জনগণ তার চোখ উপড়ে ফেলে। অন্যদিকে শাহজালালের বাবা জাকির হোসেন প্রথম দিন থেকে পুলিশের এই ভাষ্য অস্বীকার করে আসছেন।
“আমার ছেলেকে ছেলেবউ থানায় সুস্থ দেখে এসেছে। পরদিন সকালে থানায় গিয়ে আমরা জানতে পারি ছেলে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অপারেশন করি। ডাক্তার বলছে, ছেলে আর দেখতে পাবে না,” জাকির হোসেন বেনারকে বলেন।
রোববার ত্রৈমাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তা এসব বিষয় তোলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে জনবিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের যে ধাপগুলো আছে সেগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়েছে কি না তাও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করে দেখার নির্দেশ দেওয়া হয় বৈঠকে। এসময় আইজিপি বলেন, এমন কোনো কাজ পুলিশের করা উচিত হবে না যাতে জনগণ আর পুলিশ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়।
ওই বৈঠকে পুলিশের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের যতগুলো ঘটনা ঘটেছে তার সবগুলোই তদন্ত করে দ্রুততম সময়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় বলেও বৈঠকে উপস্থিত সূত্রগুলো জানাচ্ছে।
পুলিশের বক্তব্যে আশ্বস্ত নন ভুক্তভোগীরা
অতিরিক্ত বল প্রয়োগের ঘটনায় যারা বিভিন্ন সময় আহত হয়েছেন, তাঁরা পুলিশের আইজিপির নির্দেশনার খবরে খুব একটা আশ্বস্ত হতে পারছেন না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ তাঁদের একজন।
“২০০৯ সালে আমাকে পুলিশ লাঠিপেটা করার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের লোকজন হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, হামলাকারীদের বিচার হবে। কিন্তু সেই বিচার হয়নি,” বেনারকে বলেন আনু মুহাম্মদ।
ড. আনু আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গ্রহণযোগ্যতা এখন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। তাদের মুখে হঠাৎ ‘জনবান্ধব পুলিশিং’ এর কথা শুনে আশ্বস্ত হওয়া যায় না।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি ইমরান হাবীব রুমন বেনারকে বলেন, এ বছরের জানুয়ারিতে তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প আন্দোলনের বিরোধিতা করে মিছিল করে। সে সময়ও পুলিশ জলকামান, ভারী অস্ত্র-সশস্ত্র নিয়ে আন্দোলন ঠেকাতে আসে। এক বৃদ্ধকে মাটিতে ফেলে বেদম পেটায়।
গত ১৮ মে মেডিকেল অ্যাসিসটেন্টদের আন্দোলনে পুলিশ বেধড়ক পিটিয়ে শতাধিক ছাত্রকে আহত করে। একই দিন ছাত্রফ্রন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ফি বাড়ানোর প্রতিবাদে শাহবাগে আন্দোলনে নামে। তাদেরও পুলিশ লাঠিপেটা করে ও টিয়ারশেল ছোড়ে। পুলিশ ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তাৎক্ষণিক কিছু লোক দেখানো ব্যবস্থা নেয়। হঠাৎ করে পুলিশ সদাচারণ করবে বলে তিনি বিশ্বাস করছেন না।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, বিশ্বস্ততা অর্জনে পুলিশ আগের ঘটনাগুলোয় কী পদক্ষেপ নিয়েছে তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ জরুরি।
“বিভিন্ন সময়ে পুলিশকে আমরা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলতে শুনেছি। আসলে কার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, নিলেও সেটি যথেষ্ট বা দৃশ্যমান কি না তা বিবেচনায় নেওয়া দরকার। বিভিন্ন সময় আদালত পুলিশের আচরণ সম্পর্কে নির্দেশনা দিয়েছেন, জনবিশৃঙ্খলা প্রতিরোধে পুলিশের নিজস্ব কিছু নিয়মকানুন আছে সেগুলো মাঠপর্যায়ের পুলিশ অনুসরণ করছে কি না খতিয়ে দেখা দরকার,” মিজানুর রহমান বলেন।