বিতর্ক ও সমালোচনার মুখে র‍্যাবের কার্যক্রম

ঢাকা থেকে প্রাপ্তি রহমান
2017.01.25
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে র‌্যাব। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে র‌্যাব। ডিসেম্বর ২১, ২০১৬।
স্টার মেইল

সাত খুন মামলার রায়ে র‍্যাবে কর্মরত সাবেক ২৫ কর্মকর্তা ও সদস্যকে মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়ার পর নতুন করে ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে এই বাহিনী। এলিট ফোর্স হিসেবে পরিচিত র‍্যাবের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন ও বিতর্ক জোরদার হয়েছে।

এরই মধ্যে ওই বাহিনী ভেঙে দেওয়ার জন্য নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) প্রতিবেদন এবং র‍্যাব বিষয়ে আদালতের পর্যবেক্ষণ প্রকাশ হওয়ার পর সংকট গভীর হয়েছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল র‍্যাব ভেঙে দেওয়ার সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দিয়েছেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, এ বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।

এদিকে সমালোচনার মুখে র‍্যাব বলছে, নারায়ণগঞ্জে যা কিছু ঘটেছে তার দায় ব্যক্তির, বাহিনীর নয়। ১৯ জানুয়ারি হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন প্রকাশের এক দিন পর র‍্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ ব্যক্তির দায় র‍্যাব নেবে না বলে উল্লেখ করেন। তবে তিনি যখন উত্তরাঞ্চলীয় জেলায় বক্তব্য দেন, তখন দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলায় র‍্যাবের বিরুদ্ধে এক প্রবাসীকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ ওঠে।

গত ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন মামলার রায়ে বলেন, সাত খুনের ঘটনায় প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের সংশ্লিষ্টতা জাতির জন্য অত্যন্ত কলঙ্কজনক। তিনি সেনাবাহিনী থেকে প্রেষণে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকারও পরামর্শ দেন।

র‍্যাব ভেঙে দেওয়ার সুপারিশ

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ১৯ জানুয়ারি র‍্যাব ভেঙে দেওয়ার সুপারিশ করে। মানবাধিকার সংগঠনটি বলছে, জবাবদিহির অভাবে র‍্যাব একটি দুর্বৃত্ত বাহিনীতে পরিণত হয়েছে।

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল সাত খুনের ঘটনা ঘটার পরও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এই সুপারিশ করে। তখন তারা বলেছিল, র‍্যাব একটি ডেথ স্কোয়াডে পরিণত হয়েছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এই দাবির সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো। গুম, খুন ও অপহরণের পর যারা চুপ করেছিলেন বা মামলা করেও সুবিচার পাচ্ছিলেন না, সাত খুনের রায়ের পর তাঁরা এখন সংবাদমাধ্যমগুলোর সঙ্গে কথা বলছেন।

র‍্যাবের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ

সাত খুনের রায় ঘোষণার একদিন পরই শুধু র‍্যাব-১১ এর বিরুদ্ধে প্রায় এক ডজন গুম-খুন-অপহরণের অভিযোগ ওঠে। তারেক সাঈদ মোহাম্মদ ছিলেন এই র‍্যাবের অধিনায়ক। তাঁর আওতাভুক্ত এলাকাগুলো ছিল নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, মুন্সিগঞ্জ, চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, নরসিংদী ও ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ ও দোহার।

এই অঞ্চলগুলোয় ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়ত নেতাদের গুম-খুন-অপহরণের অভিযোগ ওঠে। এ ছাড়া টাকার বিনিময়ে র‍্যাবের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ ছিল।

লাকসাম থেকে অ্যাম্বুলেন্সে কুমিল্লা আসার পথে ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর অপহৃত হন উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সাংসদ সাইফুল ইসলাম হিরু এবং পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ূন কবীর পারভেজ। সাইফুল ইসলাম হিরুর স্বজনেরা বলেন, ওই রাতে অ্যাম্বুলেন্স চালকসহ চারজন ছিলেন গাড়িতে।

র‍্যাব-১১ এর একটি দল আচমকা দুজনকে তুলে নেয় ও বাকি দুজনকে আদালতে সোপর্দ করে। এ সময় পরিবারের সদস্যরা র‍্যাবের বিরুদ্ধে লাকসাম থানায় মামলা করতে গেলে থানা মামলা নেয়নি। পরে তাঁরা তারেক সাঈদ মোহাম্মদকে এক নম্বর আসামি করে আদালতে মামলা করেন।

ওই ঘটনায় বাদীপক্ষের আইনজীবী বদিউল আলম বেনারকে বলেন, সুবিচার পেতে কাঠখড় পোড়ানোর কাহিনী।

“পুলিশ মামলা নেয়নি। আদালতের নির্দেশে পুলিশ তদন্ত করে বলেছিল, র‍্যাবের সম্পৃক্ততা নেই। আমরা আদালতে না-রাজি দিলাম। সিআইডিকে তদন্তভার দিল আদালত,” বেনারকে বলেন বদিউল।

তিনি আরও বলেন, দেড় বছর হয়ে গেলেও সিআইডি কিছু বলছে না। পরে আদালতের নির্দেশে তারা তিন দফায় অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দেয়।

সাইফুল ইসলাম হিরুর ছেলে রাফসান ইসলামও বেনারকে বলেন, “তিন বছর ধরে আমরা শুধু অপেক্ষা করে আছি। বাবা কোথায় আছে শুধু এটুকু জানতে চাই।”

২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুরে র‍্যাব-১১ চারটি হত্যাকাণ্ড ঘটায়। ওই চারজন ছিলেন বিএনপি কর্মী। অপর ঘটনায় জামায়াত নেতা ও চিকিৎ​সক ফয়েজ আহম্মদকে ছাদ থেকে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। একই দিনে চার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় প্রথমে মামলা না হলেও, কয়েক মাস পর মামলা হয়।

এ ছাড়া একটি ক্লিনিকের মালিকানা নিয়ে বিতর্ক থেকে ব্যবসায়ী তাজুল ইসলাম গুম হন। পরিবারের অভিযোগ ফুপাতো ভাইয়ের সঙ্গে ব্যবসায় অংশীদারত্ব নিয়ে ঝগড়া হয়। ফুপাতো ভাই এর পক্ষে র‍্যাব কাজ করে।

এর আগে ২০১১ সালে ঝালকাঠির তরুণ লিমনের পায়ে গুলি ঠেকিয়ে আহত করার পর র‍্যাবের কার্যক্রম মারাত্মক সমালোচনার মুখে পড়েছিল। সে সময় লিমনের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়। প্রায় চার বছর পর র‍্যাব সব মামলা তুলে নেয়।

নতুন বিতর্কের সূত্রপাত

চলমান আলোচনা–সমালোচনার মধ্যে র‍্যাব নতুন করে বিতর্কে জড়িয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, প্রবাসী বাংলাদেশিকে মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে তুচ্ছ কথা-কাটাকাটির ঘটনাকে কেন্দ্র করে। তবে মাদারীপুর র‍্যাব ক্যাম্প থেকে গত শুক্রবার সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয়, শামীমকে ইয়াবা ও জাল টাকাসহ আটক করা হয়েছে। গত সোমবার শামীম জামিনে বেরিয়ে আসেন।

র‍্যাব যা বলছে

র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বেনারকে বলেন, র‍্যাবের বিপথগামী কোনো সদস্যের দায় পুরো বাহিনীর ওপর বর্তানো অনুচিত।

“র‍্যাবের বিরুদ্ধে যখনই কোনো অভিযোগ ওঠে র‍্যাব তা খতিয়ে দেখে। যেসব ক্ষেত্রে মামলা হয় সেখানে র‍্যাবের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতাও করা হয়। তবে মাঝে মাঝে বানোয়াট ও ভিত্তিহীন অভিযোগ তোলা হয়। এটা অনাকাঙ্ক্ষিত,” বলেন মুফতি মাহমুদ খান।

সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক বেনারকে বলেন, র‍্যাব গঠিত হওয়ার পর শক্ত হাতে দুষ্টের দমন করায় প্রশংসা কুড়িয়েছিল। তখনো মানবাধিকার সংগঠন ও বিবেকবান মানুষ আইনের মধ্যে থেকে কর্তব্য পালনের অনুরোধ জানায়। আজও জানাচ্ছে।

তিনি বলেন, সাত খুনের রায়ের পর এটিই প্রত্যাশিত ছিল যে, আরও যারা এমন হিংস্রতার শিকার হয়েছেন তাঁরা সুবিচার পাবেন। রাষ্ট্রেরই সেই পথটি খুলে দেওয়া দরকার।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।