মানবাধিকার কর্মীদের মতে, ধর্ষণের স্বীকারোক্তিসহ লাশ উদ্ধার বিচারিক প্রক্রিয়া এড়ানোর কৌশল
2019.02.05
ঢাকা

সম্প্রতি বিভিন্ন এলাকায় ধর্ষণের স্বীকারোক্তিমূলক চিরকুটসহ সন্দেহভাজনদের লাশ উদ্ধারের ঘটনাগুলোকে বিচারিক প্রক্রিয়া এড়িয়ে গুপ্তহত্যা বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁদের মতে এইসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত না হলে আসল অপরাধীকে আড়াল করতেও এমন খুনের ঘটনা ঘটানো হতে পারে।
এ জাতীয় গুপ্তহত্যায় ‘পুলকিত হওয়ার কিছু নেই’ উল্লেখ করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “এটি বাহবা কুড়োনোর একটি চটুল প্রক্রিয়া।”
“এক্ষেত্রে আশঙ্কার জায়গা দুটি। প্রথমত, এখানে বিচারিক প্রক্রিয়াকে পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, যে ব্যক্তির গলায় ‘আমি ধর্ষক’- এই চিরকুট ঝুলছে, তিনি বিচারিক প্রক্রিয়ায় ধর্ষক বলে প্রমাণিত হননি,” যোগ করেন তিনি।
এদিকে আসল অপরাধীকে আড়াল করতেও এমন ঘটনা ঘটানো হতে পারে বলে মনে করেন বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সাবেক নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী।
তিনি বেনারকে বলেন, “এতে কী প্রমাণ হচ্ছে? সন্দেহভাজন ধর্ষকরা কি স্বীকারোক্তি দিয়ে আত্মহত্যা করছে? এটা তো স্রেফ খুন। আমি চাই এ ধরনের প্রতিটি ঘটনার তদন্ত হোক। নইলে আসল অপরাধীকে আড়াল করতেও এমন খুনের ঘটনা ঘটানো হতে পারে।”
মরা মানুষের স্বীকারোক্তি
বাংলাদেশে এর আগে গুপ্তহত্যার বিভিন্ন ঘটনা ঘটলেও কখনো কোনো মৃতদেহের সাথে স্বীকারোক্তিমূলক নোট পাওয়া যায়নি। তবে জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া ধর্ষণ মামলার অভিযুক্ত বা সন্দেহভাজনদের যে মৃতদেহগুলো উদ্ধার করা হচ্ছে, তাঁদের প্রত্যেকের সাথেই পাওয়া যাচ্ছে স্বীকারোক্তিমূলক নোট।
এইসব নোটে ধর্ষিতার নাম উল্লেখ করে মৃতরা জানাচ্ছেন ‘আমি অমুকের ধর্ষক।’
একটি ক্ষেত্রে হত্যাকারী নিজেকে গ্রিক পুরাণের মহানায়ক ‘হারকিউলিস’ আখ্যা দিয়ে চিরকুটে ধর্ষকদের ‘সাবধান’ হতেও বলেছেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারি মহাপরিদর্শক (এআইচি) সোহেল রানা বেনারকে বলেন, “এ জাতীয় গুপ্তহত্যার পেছনে কারা রয়েছে, সে বিষয়ে পুলিশ এখনও নিশ্চিত নয়।”
ধর্ষণের স্বীকারোক্তিমূলক চিরকুট গলায় ঝোলানো প্রথম মৃতদেহটি ১৭ জানুয়ারি সাভারের আশুলিয়া থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। তারা জানায়, এটি গার্মেন্টসকর্মী ধর্ষণের সন্দেহভাজন আসামি রিপনের লাশ।
দুই সপ্তাহের মধ্যে এমন আরও দুটি মৃতদেহ পাওয়া যায়।
গত ২৬ জানুয়ারি ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলার একটি ধানক্ষেত থেকে সজল জমাদ্দারের এবং তার ছয় দিন পর পহেলা ফেব্রুয়ারি একই জেলার রাজাপুর উপজেলার ইটভাটার পাশে রাকিব মোল্লাহর মৃতদেহ উদ্ধার হয়।
পাশের জেলা পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ায় গত ১২ জানুয়ারি এক মাদরাসা শিক্ষার্থী (১৩) ধর্ষণের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার আসামি ছিলেন তাঁরা।
রাকিবের গলায় ঝোলানো চিরকুটে লেখা ছিল, ‘আমি পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ার (ধর্ষিতার নাম) ধর্ষক রাকিব। ধর্ষকের পরিণতি ইহাই। ধর্ষকেরা সাবধান – হারকিউলিস।’ আর সজলের মৃতদেহের সাথে থাকা চিরকুটে লেখা ছিল, ‘মাদ্রাসা ছাত্রীকে ধর্ষণ করার কারণে আমার এই পরিণতি।’
ধর্ষণ মামলার সন্দেহভাজন ও অভিযুক্ত আসামিদের এমন মৃত্যু দেশজুড়ে নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
গত বছর ‘আই স্ট্যান্ড ফর ওম্যান’ শিরোনামে যৌন হয়রানী বিরোধী চলচ্চিত্র আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন নির্মাতা আফজাল হোসেন মুন্না।
পহেলা ফেব্রুয়ারি তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, “হারকিউলিস পোশাকধারী হোক বা পোশাকহীন, ‘ধর্ষণ করেছ, তো মরেছ’ এই আতঙ্কটা ছড়ানো জরুরি।”
তবে মৌলবাদীদের হুমকীর মুখে দেশত্যাগ করা নারীবাদি লেখক চৈতী আহমেদ লিখেছেন, “বিচার বহির্ভূত হত্যার বিরুদ্ধে আগেও ছিলাম এখনও আছি। ধর্ষক হইলেও তাকে আগে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।”
আছে ইন্ধনের অভিযোগ
সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ইন্ধন আছে বলে মনে করা হচ্ছে। পিরোজপুরের সজল ও রাকিব নিখোঁজ ছিল বলে জানিয়েছে তাদের পরিবার।
এর আগে আশুলিয়ায় রিপনের লাশ উদ্ধার হওয়ার পর তার পরিবারের সদস্যরাও দাবি করেছিলেন, আগেই তাকে সাদা পোশাকে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়েছিল। তবে এসব হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেছে পুলিশ।
এ নিয়ে আলাপকালে এআইজি সোহেল রানা বলেন, “এখন পর্যন্ত যে কটি ঘটনা ঘটেছে, প্রতিটি ঘটনাতে মামলা হয়েছে। পুলিশ তদন্ত করছে। তদন্ত শেষ হওয়ার আগে কিছু বলা যাচ্ছে না।”
বিপদ বাড়ছে ধর্ষিতার
এ জাতীয় গুপ্তহত্যার কারণে ধর্ষিতা এবং তাঁর পরিবারের বিপদ আরো বাড়ছে। ২৬ জানুয়ারি সজল জমাদ্দারের লাশ উদ্ধারের পর তার পরিবার এই মৃত্যুর জন্য ধর্ষণের শিকার মেয়েটির বাবা ও ফুপাকে দায়ী করে থানায় অভিযোগ করেছে।
পহেলা ফেব্রুয়ারি রাকিব মোল্লার লাশ পেয়ে তার বাবা আবুল কালামও ছেলের মৃত্যুর দায় চাপিয়েছেন ঘটনার শিকার হওয়া মাদ্রাসা ছাত্রীর পরিবারের ওপর। “আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই আমি,” বেনারকে বলেন তিনি।
ধর্ষিতার একজন স্বজন বেনারকে জানান, যে দুই তরুণের বিরুদ্ধে তাঁরা অভিযোগ করেছেন, তারা প্রভাবশালী পরিবারের। চিরকুট লেখা অবস্থায় তাদের মৃতদেহ উদ্ধারের পর তাঁদের পরিবার একরকম আত্মগোপনে আছেন।
“ধর্ষণের শিকার শিশুটি ভয়ে-অপমানে কুঁকড়ে আছে।,” বলেন তিনি।
শিশু ধর্ষণই বেশি হচ্ছে
বিপুল সংখ্যক নারী ও শিশু প্রতিবছর ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসেবে গত পাঁচ বছরে দেশের থানাগুলোতে প্রায় ১৯ হাজার ধর্ষণ মামলা রুজু হয়েছে। যার সিংহভাগের শিকার শিশুরা।
এছাড়া মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র গত পাঁচবছরে যে চার হাজার ধর্ষণের ঘটনা নথিবদ্ধ করেছে, সেখানেও দেখা গেছে আক্রান্তদের ৮৬ শতাংশ শিশু।
রাকিবের মৃতদেহ উদ্ধারের পরদিনই, ১৮ জানুয়ারি রাজবাড়িতে পঞ্চম শ্রেণির এক শিশুকে ধর্ষণ করে দুই ঘোড়ার গাড়ির চালক। পরের দিন ১৯ জানুয়ারি নীলফামারিতে ধর্ষিত হয় আট বছর বয়সী আরেক শিশু।
নিশ্চয়তা নেই বিচারের
পুলিশ এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলছে, নানা জটিলতার কারণে ধর্ষণের বিচার নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।
দেশের শীর্ষস্থানীয় বাংলা দৈনিক প্রথম আলো গত অক্টোবরে নারী ও শিশু নির্যাতন সংক্রান্ত মামলার হালচাল নিয়ে একটি বই প্রকাশ করে। যার শিরোনাম ছিল ‘সাজা মাত্র তিন শতাংশ’।
এই প্রেক্ষাপটে ধর্ষিতাদের আত্মীয-পরিজনসহ সমাজের একটি অংশ আইন-আদালতকে উপেক্ষা করে হলেও ধর্ষকের তড়িৎ বিচার চায়। আবার আরেকপক্ষ এর ঘোর বিরোধী।
তবে মানবাধিকার কর্মীদের মতে, কোনো অবস্থাতেই বিচার প্রক্রিয়াকে এড়িয়ে গুপ্তহত্যা সমর্থনযোগ্য নয়।
“একটা সময় ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের ঘটনাকেও মানুষ স্বাগত জানিয়েছিল। যার ধারাবাহিকতায় পরে নারায়ণগঞ্জের সাতখুনের মতো ঘটনাও ঘটেছে,” বলেন মিজানুর রহমান।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে সাতখুনের ঘটনা ঘটে। র্যাবের নেতৃত্বে সংঘটিত ওই হত্যাকাণ্ডের বিচার এখন শেষ পর্যায়ে।