যুবলীগ নেতা হত্যার জের: টেকনাফে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আরও দুই রোহিঙ্গা নিহত

জেসমিন পাপড়ি ও আবদুর রহমান
2019.09.13
ঢাকা ও কক্সবাজার
190913_crossfire_coxsbazar_1000.jpg টেকনাফের শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাহারায় একজন পুলিশ সদস্য। ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯।
[আবদুর রহমান/বেনারনিউজ]

কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় পুলিশের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দুই রোহিঙ্গা যুবক নিহত হয়েছেন। পুলিশের দাবি, নিহতরা স্থানীয় যুবলীগ নেতা ওমর ফারুক হত্যা মামলার পলাতক আসামি ছিলেন।

এই দুজনকে নিয়ে ফারুক হত্যার ঘটনায় কথিত বন্দুকযুদ্ধে মোট ছয় রোহিঙ্গা নিহত হলেন।

গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের জাদিমুড়া শরণার্থী ক্যাম্পের নিকটবর্তী পাহাড়ি এলাকায় এই ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা ঘটে বলে বেনারকে জানান টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ।

তবে নিহতদের পরিবার অভিযোগ করেছে, এটা পুলিশের পরিকল্পিত হত্যা। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, অপরাধী যে মাত্রারই হোক না কেন, আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তার বিচার করতে হবে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে এভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে থাকা অবস্থায় মানুষ বন্দুকযুদ্ধে নিহত হচ্ছে। আবার কখনো কখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, দুষ্কৃতকারীরা তাদের সাথে বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার প্রেক্ষিতে নিহত হয়েছে। জনমনে এই বক্তব্য নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।”

তিনি বলেন, “যত বড় অপরাধী হোক না কেন, বাংলাদেশি বা রোহিঙ্গা— যে কারও ক্ষেত্রেই আইনের যথাযথ পথ অনুসরণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, আইনবহির্ভূত ঘটনা এই ধরনের আরেকটি ঘটনাকে আমন্ত্রণ জানায়।”

কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বেনারকে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এ ধরনের অভিযান বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করা না গেলে, এই প্রক্রিয়ায় অপরাধ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে না।”

বৃহস্পতিবার রাতে নিহতরা হলেন হ্নীলার নয়াপাড়া শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা জমির আহমদের ছেলে আবদুল করিম (২৪) ও সৈয়দ হোসেনের ছেলে নেছার আহমদ (২৭)। তাঁরা দুজনই মিয়ানমার সেনাদের নির্যাতনের মুখে মংডু জেলা থেকে পালিয়ে এসে কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

ওসি জানান, নিহতরা টেকনাফে বিভিন্ন ডাকাতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে হত্যা, ডাকাতি, অপহরণসহ একাধিক মামলা রয়েছে।

এর আগে ২২ আগস্ট বৃহস্পতিবার রাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুব সংগঠনের নেতা ওমর ফারুককে টেনে হিঁচড়ে তুলে নিয়ে গিয়ে মাথায় গুলি করে হত্যা করে অস্ত্রধারী রোহিঙ্গারা। এ ঘটনার পরই পুলিশ শরণার্থী ক্যাম্পে অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে জোরদার অভিযান শুরু করে বলে জানান কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন।

তিনি বেনারকে জানান, “অভিযানে গেলে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা পুলিশকে লক্ষ্যে গুলি চালায়, পুলিশও আত্মারক্ষার্থে গুলি চালায়, এতে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা ঘটছে। পুলিশ কাউকে ইচ্ছে করে গুলি করেনি।”

ওসির ভাষ্য

ওসি প্রদীপের ভাষ্য অনুযায়ী, টেকনাফের জাদিমুরা শরণার্থী ক্যাম্পে যুবলীগ নেতা হত্যা মামলার আসামিরা বৃহস্পতিবার রাতে অস্ত্র-সশস্ত্র নিয়ে অবস্থান করছে খবর পেয়ে সেখানে অভিযানে যায় পুলিশের একটি দল। পুলিশ সেখানে পৌঁছানোর পর অস্ত্রধারীরা গুলি ছুড়তে থাকে। তখন আত্মরক্ষার্থে পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়।”

ওসি জানান, ডাকাত দলের সদস্যরা গুলি ছুড়তে ছুড়তে একপর্যায়ে পালিয়ে যায়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে দুজনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে।

গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁদের প্রথমে টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্যা কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখানে জরুরি চিকিৎসার পর তাঁদের অবস্থার অবনতি ঘটলে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়। এরপর তারা মারা যান।

ওসি জানান, ওই ঘটনায় পুলিশের তিন সদস্য আহত হন।

টেকনাফ উপজেলা চিকিৎসক শঙ্কর চন্দ্র দেব নাথ বেনারকে বলেন, “পুলিশ রাতে গুলিবিদ্ধ দুজনকে নিয়ে আসে। তাঁদের শরীরে দুটি করে গুলির আঘাত ছিল।”

তিনি জানান, আহত পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

ওসি জানান, ঘটনাস্থল থেকে দুটি দেশীয় অস্ত্র ও কয়েক রাউন্ড​ গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। নিহত দুই রোহিঙ্গার মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে রয়েছে। এ ব্যাপারে অস্ত্রসহ সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলার প্রক্রিয়া চলছে।

পরিবার বলছেহত্যা

নিহতদের পরিবারের দাবি, তাঁদের তুলে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে পুলিশ।

নিহত করিমের বাবা জমির আহমদ বেনারকে বলেন, “দুই দিন আগে নেছার ও করিমকে পুলিশ পরিচয় দিয়ে সাদা পোশাকের একটি দল ধরে নিয়ে যায়। পরে আজ রোহিঙ্গা মাঝিদের কাছ থেকে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ তাদের মারা যাওয়ার খবর পাই।”

“আমি মনে করি, পুলিশ তাদের হত্যা করেছে। তারা দুজন এমন কোনও অপরাধ করেনি যে, তাদের গুলি করে মেরে ফেলতে হবে। এটা খুবই অন্যায়,” বলেন তিনি।

পরিবারের এ অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে ওসি প্রদীপ বলেন, দুই দিন আগে নিহতদের কাউকেই আমরা গ্রেপ্তার করেনি।

“আগে অস্ত্রধারী রোহিঙ্গারা পুলিশের উপর গুলি চালায়, এরপর পুলিশও গুলি করে। উভয় পক্ষে গোলাগুলিতে এ ঘটনা ঘটে। জেনেশুনে কাউকে গুলি করে হত্যা করা হয়নি,” বলেন ওসি প্রদীপ।

জেলা পুলিশ সূত্র জানায়, ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গত দুই বছরে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় মোট ৩৭ জন রোহিঙ্গা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে উখিয়ায় ২৪ জন ও টেকনাফে ১৩ জন।

নিহতদের মধ্যে দুজন নারী।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।