কক্সবাজারে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দুই রোহিঙ্গাসহ তিনজন নিহত

জেসমিন পাপড়ি
2019.09.19
ঢাকা
190919_RoHINGYA_CRoSFIRE_1000.jpg টেকনাফের জাদিমুরা শরণার্থী শিবিরে খাবার পানি সংগ্রহের লাইনে কলসি বসিয়ে অপেক্ষা করছেন রোহিঙ্গারা। ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯।
[আবদুর রহমান/বেনারনিউজ]

কয়েক দিনের ব্যবধানে কক্সবাজারের পুলিশের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে আবারও দুই রোহিঙ্গাসহ তিনজন নিহত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার ভোর ৪টার দিকে টেকনাফের বাহারছড়ার পাহাড়ি এলাকায় এ ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা ঘটে বলে বেনারকে নিশ্চিত করেন টেকনাফ মডেল থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ।

তাঁর দাবি, নিহতরা হত্যা, অস্ত্র ও মাদকসহ বিভিন্ন মামলার আসামি ছিলেন।

এদিকে ২২ আগস্ট স্থানীয় যুবলীগ নেতা ওমর ফারুক হত্যার ঘটনায় এখন পর্যন্ত বন্দুকযুদ্ধে ছয়জন রোহিঙ্গা শরণার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। এ ধরনের হত্যাকাণ্ড রোহিঙ্গাদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করেছে বলেও উল্লেখ করেছে তারা।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অপরাধ কমাতে সাহায্য করে না। বরং এ ধরনের একটি ঘটনা বিচারবহির্ভূত আরেকটি ঘটনাকে আমন্ত্রণ জানায়।”

তিনি বলেন, “আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রত্যেকটি বন্দুক যুদ্ধের পরে একই ধরনের যে বক্তব্য দিয়ে থাকে, তা নিয়ে জনমনে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। মনে রাখতে হবে, অপরাধীরও ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এ জন্য আইনের যথাযথ পথ অনুসরণ করা জরুরি।”

বৃহস্পতিবার ভোরে বন্দুকযুদ্ধে নিহতরা হলেন, কক্সবাজারের উখিয়া বালুখালী ১৭ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ফজল আহাম্মদের ছেলে মোহাম্মদ জামিল (২০), একই ক্যাম্পের নবী হোসেনের ছেলে আসমত উল্লাহ (২১) ও টেকনাফের বাহারছড়া নতুনপাড়া এলাকার মৃত মোহাম্মদ আলীর ছেলে রফিক (২৪)।

পুলিশ জানায়, ওই ঘটনায় তিন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। ঘটনাস্থল থেকে তাঁরা তিনটি দেশি বন্দুক ও ছয় রাউন্ড গুলি উদ্ধার করেছেন।

ওসি প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, “বুধবার রাতে হত্যা, অস্ত্র ও মাদক মামলার তিনজন আসামিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা চুরি, অপহরণ, খুনসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেন।”

“পরে তাঁদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী বৃহস্পতিবার ভোররাতে বাহারছড়া শামলাপুর ঢালায় জঙ্গল এলাকায় অস্ত্র ও চোরাই মালামাল উদ্ধারের জন্য গেলে তাঁদের সহযোগী অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে,” তিনি বলেন।

“পুলিশও আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি চালায়। এক পর্যায়ে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা পালিয়ে গেলে ঘটনাস্থল থেকে তিনজনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়,” বলেন প্রদীপ কুমার।

তিনি বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁদের কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পাঠালে সেখানকার ডাক্তার তাঁদের মৃত ঘোষণা করেন।

জেলা পুলিশ সূত্র জানায়, ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গত দুই বছরের বেশি সময়ে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় মোট ৪০ জন রোহিঙ্গা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে উখিয়ায় ২৪ জন ও টেকনাফে ১৬ জন।

এইচআরডব্লিউ’র উদ্বেগ

বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) বলছে, কক্সবাজারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুব সংগঠনের স্থানীয় নেতা ওমর ফারুককে ২২ আগস্ট হত্যার সাথে জড়িত বলে দাবি করে বাংলাদেশ পুলিশ এখন পর্যন্ত ছয় রোহিঙ্গা শরণার্থীকে হত্যা করেছে।

সংস্থাটি জানায়, ফারুক হত্যার বিচার নিশ্চিত করা ‘প্রতিক্রিয়াশীল এবং সংক্ষিপ্ত’ না হওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারকে সতর্ক করে আসছিলেন জাতিসংঘের বিভিন্ন মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা।

এইচআরডব্লিউ জানায়, সন্দেহভাজনদের হেফাজতে নেওয়ার পরে জোর করে নিখোঁজ করা বা হত্যা করা বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডের পরে, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ বলেছে, এই ব্যক্তিরা ‘ক্রসফায়ার’ বা একটি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গছেন। এই একই ব্যাখ্যা প্রায় প্রতিটি বিচারবহির্ভূত হত্যার পরে ব্যবহার করা হচ্ছে।

এইচআরডব্লিউ জানায়, এই হত্যাকাণ্ড কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে তীব্র ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছে।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের উত্তর রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান শুরুর পর নির্যাতনের মুখে প্রাণ বাঁচাতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, নতুন পুরোনো মিলিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে ১২ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন। কক্সবাজারে জেলার টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে তাঁরা অবস্থান করছেন।

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমার দ্বি-পাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর করে। দুই দফা প্রত্যাবাসনের তারিখ ঠিক করা হলেও তা ব্যর্থ হয়, কারণ রোহিঙ্গাদের আশঙ্কা মিয়ানমারে এখনো তাঁদের জন্য অনিরাপদ।

ফারুক হত্যার পর স্থানীয়রা রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা চালায়। ২৭ নম্বর শিবিরের এক শরণার্থী হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেন, “স্থানীয়রা তাঁদের মারধর বা হত্যার হুমকি দিয়ে চলেছে। তারা বলছে, রোহিঙ্গারা কেন আমাদের জমি ছাড়ছে না?”

এইচআরডব্লিউ দাবি করেছে, উত্তেজনা প্রশমিত করার পরিবর্তে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা এসব আক্রমণ থেকে শরণার্থীদের সুরক্ষা দিতে অস্বীকার করছেন। কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গাদের শাস্তি দেওয়ার পাশাপাশি অপরাধমূলক কাজে ইন্ধন দেওয়ার অভিযোগ তুলে ইন্টারনেট সুবিধা কমানো, শরণার্থীদের কাছে সিম কার্ড বিক্রি বন্ধ করতে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিদের নির্দেশও দিয়েছে।

গণহত্যা থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আবার জীবন হারানোর শঙ্কায় ফেলানো উচিত নয় বলে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানায় এইচআরডব্লিউ।

রোহিঙ্গারা বড় ধরনের বোঝা: প্রধানমন্ত্রী

এদিকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ধরনের বোঝা বলে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এখন মিয়ানমারের উচিত তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেওয়া।

বৃহস্পতিবার গণভবনে যুক্তরাজ্যের অল-পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপের (এপিপিজি) দুটি পৃথক প্রতিনিধিদল তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। বৈঠকের পরে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের এসব কথা জানান।

শেখ হাসিনা বলেন, “এখন রোহিঙ্গারা আমাদের জন্য একটি বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এদের কারণে স্থানীয় মানুষকে ব্যাপক ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে “

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি ভারতে আশ্রয় নেওয়ার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, “আমরা মানবিক দিক বিবেচনা করে রোহিঙ্গাদেরও আশ্রয় দিয়েছি।”

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার থেকে আবদুর রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।