রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহ হত্যা: প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ

আহম্মদ ফয়েজ, আব্দুর রহমান ও সুনীল বড়ুয়া
2021.10.04
ঢাকা ও কক্সবাজার
রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহ হত্যা: প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে মো. ছলিম (বাঁ থেকে দ্বিতীয়) ও মো. শওকত উল্লাহকে কক্সবাজার আদালতে নিযাচ্ছে পুলিশ। ৩ অক্টোবর ২০২১।
[সুনীল বড়ুয়া/বেনারনিউজ]

গত বুধবার রাতে শরণার্থী শিবিরের ভেতর নিজ সংগঠনের কার্যালয়ে শীর্ষস্থানীয় রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহ (৫০) খুন হবার সময় ওই রুমে উপস্থিত থাকা একজন রোহিঙ্গা দিনমজুর সোমবার বেনারকে জানালেন সেই রাতে ঘটে যাওয়া হত্যার রোমহর্ষক বিবরণ।

চল্লিশ বছর বয়সী ওই রোহিঙ্গা দিনমজুর জানান, অজ্ঞাত পরিচয়ের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা মাত্র কয়েক মিনিটেই হত্যা করে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচআর) চেয়ারম্যান মুহিব উল্লাহকে। 

ওই রাতে দশ-বারো জন শরণার্থীর সাথে মুহিব উল্লাহ তাঁর অফিসে ত্রাণের সংকট, জিনিসপত্র দাম বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্য সেবার মান নিয়ে কথা বলছিলেন। এমন সময় তিনি ওইখানে উপস্থিত হন বলে জানান ওই প্রত্যক্ষদর্শী।

তিনি উপস্থিত হবার “তিন-চার মিনিট পর পরই মাথায় টুপি ও মুখে মাস্ক পরে সাত থেকে আটজন অস্ত্রধারী ওই অফিসে ঢুকে পড়ে। তারা জানতে চায় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে পাঠাতে ক্যাম্পের ভিতর প্রতিটি ব্লকে সাত সদস্যের গ্রুপ কে তৈরি করল?” বলেন ওই প্রত্যক্ষদর্শী। 

“এ কথার বলার পর পরই তাঁর (মুহিব উল্লাহ) মাথার উপর অস্ত্র তাক করে নড়াচড়া না করতে হুমকি দেয় সন্ত্রাসীরা। এসময় আমাকে মাথা নিচের দিকে করে মাটিতে শুয়ে থাকার নির্দেশ দেয়,” যোগ করেন তিনি।

তিনি বলেন, “আমি শুয়ে পড়তেই একজন মুহিব উল্লাহর বুকে তিনটি গুলি করে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মুহিব উল্লাহ মাটিতে পড়ে যান। এসময় অফিসে থাকা মানুষজন পালিয়ে যায়।”

গুলি খেয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় মুহিব উল্লাহ দাঁড়ানোর চেষ্টা করলে “এক সন্ত্রাসী ফিরে এসে তাঁর বুকে ও চোখে আরো দুটি গুলি করে। এরপর আশপাশের লোকজন এগিয়ে আসলে তারা পালিয়ে যায়,” বলেন ওই প্রত্যক্ষদর্শী।

সন্ত্রাসীদের সবার পরনে থ্রি কোয়াটার পেন্ট ও টি-শার্ট এবং মুখে মাস্ক ছিল। সবার হাতেই ছিল পিস্তল, জানান তিনি।

“মুহিব উল্লাহ মৃত্যুর পর আমরা সবাই ভয়ে আছি, রাত হলে চোখে ঘুম আসে না। আমরা সরকারের কাছে জীবনের নিরাপত্তার পাশাপাশি এ হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানাচ্ছি, “ বলেন এই দিনমজুর।

মুহিব উল্লাহর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন এমন একজন স্বেচ্ছাসেবী বেনারকে জানান, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সহায়তা করার জন্য ব্লক-ভিত্তিক সাত সদস্যের কমিটিগুলোকে সংস্কারের কাজে সম্প্রতি হাত দিয়েছিলেন মুহিব উল্লাহ। গত পাঁচ মাস ধরে তিনি সক্রিয়ভাবে এই কাজটি করছিলেন। 

গ্রেপ্তার পাঁচ, মুহিব উল্লাহর ভাইকে হুমকি

নির্যাতনের শিকার হয়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের শীর্ষস্থানীয় নেতা মুহিব হত্যার ঘটনায় সরাসরি সম্পৃক্ত থাকা কাউকে এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইন শৃঙ্খলাবাহিনী। যদিও এই ঘটনা সোমবার বিকেল পর্যন্ত সন্দেহভাজন হিসেবে পাঁচজনকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন)। 

মুহিব উল্লাহর ছোটভাই হাবিব উল্লাহ বলেন, “ঘটনার দিন যাদের আমরা চিনতে পেরেছি, তাদের কেউ এখনো পুলিশের হাতে ধরা পড়েনি। তবে যে পাঁচজন ধরা পড়েছে তারা ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে বলে শুনতে পাচ্ছি।”

এ ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলাটি প্রত্যাহার করে নিতে তাঁর ওপর নানা ধরনের চাপ আসছে জানিয়ে হাবিব বলেন, “ঘটনার মামলা তুলে নেওয়ার জন্য সন্ত্রাসীরা তাঁকে ভয়েজ ম্যাসেজ পাঠিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে, নানাভাবে গালমন্দ করছে।”

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উখিয়া থানার উপ-পরিদর্শক কার্তিক চন্দ্র পাল বেনারকে বলেন, এ ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে এ পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে মো. সেলিম উল্লাহ ও শওকত উল্লাহ দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।

তবে ঘটনায় তাঁদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে কিনা জানতে চাইলে, সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে এ বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।

এই মামলাটি পুলিশ খুব গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছে বলে বেনারকে জানান কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম।

ইতিমধ্যে রিমান্ড মঞ্জুর হওয়া দুই আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য’ পাওয়া গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “তবে তদন্তের স্বার্থে এ সব বলা যাচ্ছে না।” 

এদিকে নিরাপত্তার অভাবে মুহিব উল্লাহ হত্যার বিচারের দাবিতে কোনো আন্দোলন করা সম্ভব হচ্ছে না উল্লেখ করে রোহিঙ্গা ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা খিন মং জানান, “যেভাবে মামলার তদন্ত এগোচ্ছে তাতে মনে হয়, ন্যায় বিচারের আশা দেখছি না। আমরা স্বচ্ছ ও আইনি প্রক্রিয়ায় প্রকৃত হত্যাকারীদের বিচার চাই।”

“সহকর্মী ও আমাদের নেতা মুহিব উল্লাহ খুন হবার পর থেকে আমরা সবাই ভয়ে আছি। বিশেষ করে আমাদের সংগঠনের সদস্যরা টার্গেটে রয়েছে,” বেনারকে বলেন এআরএসপিএইচআর’র সহ-সভাপতি আব্দুর রহিম।

সাধারণত আগে রাতের বেলায় শরণার্থী শিবিরে অনেক লোক চলাচল করত জানিয়ে তিনি বলেন, মুহিব উল্লাহ হত্যার পর থেকে লোক চলাচল খুব কমে গেছে।

“গত চার দিন ধরে ভয়ে ঘর থেকে বের হচ্ছি না। রাত হলে এখানে খুব বেশি ভয় লাগে,” বলেন আব্দুর রহিম। 

muhib-2.jpg
কক্সবাজার উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া এলাকায় আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস-এর কার্যালয়, যেখানে শীর্ষ রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঘরের মেঝেতে এখনও রক্তের দাগ লেগে আছে। ৩ অক্টোবর ২০২১। [সুনীল বড়ুয়া/বেনারনিউজ]

স্বার্থান্বেষী মহলের সম্পৃক্ততা দেখছে সরকার

দেশে বিদেশে আলোড়ন তৈরি করা রোহিঙ্গা নেতা হত্যাকাণ্ডের পেছনে স্বার্থান্বেষী কোনো আন্তর্জাতিক মহলের সম্পৃক্ততা থাকতে পারে বলে সন্দেহ পোষণ করছেন সরকারের শীর্ষস্থানীয় মন্ত্রীরা। 

বুধবার রাতে মুহিব উল্লাহ হত্যার দুই দিন পর শনিবার এই ঘটনায় দেয়া আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন গণমাধ্যমকে বলেন, “মুহিব উল্লাহ নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরত যেতে চেয়েছিলেন বলেই কিছু স্বার্থান্বেষী মহল তাঁকে হত্যা করে থাকতে পারে।” 

প্রত্যাবাসনের পক্ষে সক্রিয় থাকায় মুহিব উল্লাহকে হত্যা করা হয়েছে উল্লেখ করে এ হত্যাকাণ্ডে যে বা যারা জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

এদিকে “রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টিতে কোনো বিদেশি সংস্থা জড়িত কি না তা তদন্ত করা হচ্ছে,” বলে সোমবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সাংবাদিকদের জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।

“কারা এ অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করার প্রয়াস পাচ্ছে এবং কোনো বিদেশি সংস্থা এর সঙ্গে জড়িত আছে কি না, সবই আমরা তদন্ত করে দেখছি,” জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “আমরা এখনো কিছু বলতে পারছি না। আমরা অনেক কিছুই সন্দেহ করছি। তদন্তের পরই আপনাদের জানাব।”

“রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অস্থির পরিবেশ সৃষ্টির জন্য আগেও মিয়ানমার থেকে বিভিন্নভাবে অস্ত্র এসেছে। এ অস্ত্র নিয়ে এবং আধিপত্য বিস্তার করার জন্য বিভিন্ন গ্রুপে মারামারি দেখা গেছে,” বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

তবে তাঁর মতে “রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা শিথিল হয়নি।”

“মনে রাখতে হবে, দুইটি থানার কিছু অংশে ১১ লাখ লোক বাস করে। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর সবকিছু মেইনটেনেন্স করা খুব সহজ কাজ নয়। আমরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া দিচ্ছি। এটি কিছুদিনের মধ্যে শেষ হবে। ওয়াচ টাওয়ার করছি, সেটিও কিছুদিনের মধ্যে শেষ হবে,” বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। 

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমনপীড়নের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর দেশটির রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা। বর্তমানে নতুন ও পুরানো মিলে কক্সবাজারের ৩৪টি রোহিঙ্গা শিবির এবং নোয়াখালীর ভাসানচরে বসবাস করছেন প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা। 

মিয়ানমারের বিরুদ্ধে করা অভিযোগ সম্পর্কে বক্তব্য জানতে চেয়ে ইমেইল ও মোবাইলে বার্তা পাঠালেও কোনো উত্তর দেয়নি ঢাকাস্থ মিয়ানমার দূতাবাস। 

নোট: নিরাপত্তার স্বার্থে প্রতিবেদনে উল্লেখিত প্রত্যক্ষদর্শীর নাম ও ছবি প্রকাশ করা হলো না।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।